১৫ই ফেব্রুয়ারি: বিশ্বের ইতিহাসে ঘৃণ্য এক রেকর্ড গড়েছিলেন খালেদা জিয়া

0

সময় এখন:

বিশ্বের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে স্বল্প মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তাও আবার গায়ের জোরে। আসুন সেই ইতিহাস জেনে নিই।

আজ ১৫ই ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৬ সালের এই দিনে স্বৈরাচার বিএনপি প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের আমলের মত পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। তৎকালীন বিএনপি নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সব বিরোধীদলের বর্জন ও প্রতিরোধের মুখে গায়ের জোরে লোক দেখানো নির্বাচন করে বিএনপি। কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় ৪৮টি আসনে ভোট গ্রহণের আগেই ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হন।

নির্বাচনের পরিবেশ এতই গোলযোগপূর্ণ ছিল যে ১০টি আসনের ফলাফল নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনি। বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত এই নির্বাচনে বিএনপি প্রহসনের মাধ্যমে ৯৭ শতাংশ আসন দখল করে, বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসানো হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত খুনি- ফ্রিডম পার্টির নেতা খন্দকার আব্দুর রশিদকে।

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রের প্রকৃত চেহারা পুনরায় ফুটে ওঠে। বিএনপির শাসনামলে নির্বাচনি সংস্কৃতি বরাবরই ছিল খুবই ভয়ংকর। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে হেডলাইন প্রচারিত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশের কম ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। সে সময়ের মাগুরা ও মিরপুরের দুটি উপনির্বাচনেও তা প্রমাণিত হয়। ক্ষমতাসীন বিএনপি আসন দুটিতে তাদের দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিতের জন্য ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নেয়। জনগণের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচন বয়কট করে।

ফলে এটি স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন আমলের ১৯৮৮-এর নির্বাচনের মতো আরও একটি ‘নামকাওয়াস্তে’ নির্বাচনে পরিণত হয়। বিএনপির প্রার্থীদের কোনও আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। ’৮৮-এর নির্বাচনের মতোই এতেও অংশ নেয় বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টি, যাতে ফারুক ঢাকার রমনা আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়।

বিগত বছরগুলোতে সরকারের ব্যর্থতা ও নানারকম অনিয়ম, রাজনৈতিক অপকর্মের ফলে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে বিএনপির বিরুদ্ধে। সারাদেশে বিএনপির প্রতি সৃষ্টি হয় তীব্র অনাস্থা। এমতাবস্থায় বিএনপির নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই একক ও স্বৈরাচারি সিদ্ধান্তে বিচারপতি একেএম সাদেকের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পরিকল্পনা অনুসারে ক্ষমতা পুনঃ দখল করতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি।

অপর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন শুধু বর্জনই করেনি, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করতে রাস্তায় নামে। এমনকি নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাদের কেউই তেমন প্রকাশ্যে কোনও প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনের দিন অনেক জায়গায় ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ ভোটারদের তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে। সারাদেশের আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচন বর্জন করেন। ১৫০ জন নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী শুধুমাত্র নির্বাচনের দিনেই ১২ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং অনেক ভোটকেন্দ্র ছিল ভোটারবিহীন। বিভিন্ন কেন্দ্রে সিল মারার দৃশ্য পরদিন দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পরবর্তীতে নিজে স্বীকার করেছেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল না। দেশবাসী ঘৃণাভরে ওই একতরফা নির্বাচনি তামাশা বর্জন করে। নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ১৬ তারিখ থেকে দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। তাদের বাধার মুখে সরকার গঠন করে বিএনপি। বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদকে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসিয়ে জাতীয় সংসদকে কলঙ্কিত করা হয়। ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী- বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি রশিদকে কুমিল্লা থেকে জিতিয়ে আনে বিএনপি।

নির্বাচন হয়েছিল ২৫২টি আসনে। শেষ পর্যন্ত কমিশন ২৪২টি আসনের নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করতে পেরেছিল। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। বিএনপির প্রতি জনগণের ঘৃণা ও ক্রোধ বিস্ফোরিত হয় এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। বিএনপি সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অবৈধ বিএনপি সরকারের পতনের লক্ষ্যে স্বতঃস্ফূর্ত জনগণ প্রতিষ্ঠা করে ‘জনতার মঞ্চ’। জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী খালেদা জিয়া সরকার এবং ৩০শে মার্চ খালেদা জিয়া সরকারের পতন ঘটে। সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আপসহীন নেতৃত্বে বিজয় সূচিত হয় জনগণের।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনমতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিএনপি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মতো তামাশার নির্বাচন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্প সময়ের সংসদ ও সরকার গঠনের এক জঘন্য নজির সৃষ্টি করেছিল। আর খালেদা জিয়া অর্জন করেছিলেন এক কলঙ্কজনক রেকর্ড।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।