অর্থনীতি ডেস্ক:
ইদানিং খুব বাজার পেয়েছে দেউলিয়া শব্দটা। রাষ্ট্রের ঋণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রাখলেও দেউলিয়া হওয়ার উদ্বেগে রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ গরম। বিশেষ করে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর সাথে ব্যাপক মাখামাখি আছে, এমন পোষা বুদ্ধিজীবীরা মনগড়া ও মিথ্যা তথ্যকে পুঁজি করে একটি গুজব ছড়াচ্ছেন যে, বাংলাদেশ নাকি ২০২৪ সালে দেউলিয়া হয়ে যাবে। আসলেই কি পরিস্থিতি তেমন? একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
ব্যক্তি দেউলিয়া হওয়া আর একটি দেশের দেউলিয়া হওয়া এক বিষয় নয়। একটা দেশ প্রকৃত অর্থে দেউলিয়া হয় না। সাধারণত কোনো দেশ ঋণের কিস্তি বা বন্ড পেমেন্ট করতে ব্যর্থ হলে দেশটিকে দেউলিয়া বলা হয়। দেউলিয়া হলে সাধারণত আউটস্ট্যান্ডিং লোন পুনঃ তফসিল করা যেতে পারে। আবার আইএমএফ এর কাছ থেকে জামিন নেয়া মানে বেইল আউট প্যাকেজ নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আইএমএফ-এর কঠিন সব শর্ত মানতে হয়।
এখানে একটি বিষয় খোলাসা করা যাক। আইএমএফ-এর ঋণ মানেই কিন্তু বেইল আউট নয়। ফিসক্যাল ডেফিসিট, মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণ, বাফার রিজার্ভসহ অনেক কারণে আইএমএফ বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ২০২০ সালে কোভিড মোকাবেলার জন্য ৭৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেয়। এর আগে আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে।
আচ্ছা, এবার দেখা যাক বিএনপির পোষা বুদ্ধিজীবীদের প্রসবকৃত ‘বাংলাদেশর দেউলিয়া হওয়া’ তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করে।
প্রথমত, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে দেশটিকে ততটা বেগ পেতে হয় না যতটা বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে পেতে হয়। ঋণ শোধ করতে না পারাটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। যা সরাসরি সভেরেইন রেটিং-এ প্রভাব ফেলে। একবার কোনো দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশটির জন্য প্রায় সকল সম্ভাব্য উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অথবা ঋণ পেলেও কঠিন শর্তে, উচ্চ সুদে এবং স্বল্প মেয়াদে ঋণ মেলে। এজন্য কোন দেশই চায় না এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে।
শ্রীলঙ্কা যেভাবে শ্রীলঙ্কা হয়েছে, তার অন্যতম কারণ ছিল তাদের সামর্থের বাইরে জীবন-যাপন ব্যবস্থা। ঋণ করে ঋণ শোধ করা। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বন্ডগুলির ম্যাচিউরিটি ও উচ্চ সুদে মার্কেট বরোয়িং। ঋণ করে ঋণ শোধ করার সমস্যা হল, যদি কখনো নতুন ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন আগের ঋণগুলি পরিশোধ করার ক্ষমতা থাকে না।
ব্যক্তি পর্যায়ে উদাহরণ দেয়া যাক। অনেক পরিচিত মানুষকে দেখবেন ৩-৪টা ক্রেডিট কার্ড ক্যারি করে। একটা থেকে টাকা তুলে আরেকটার বিল শোধ করে। যখন সব কিছু কঠিন হয়ে যায় তখন নতুন কার্ড বা লোনের জন্য চেষ্টা করে। এটাই হলো দারিদ্রের দুষ্টচক্র। সামর্থ্যের বাইরে জীবন-যাপন করতে গেলে একসময় চোরবালিতে ডুবে যেতে হয়। তাই গুরুজনরা বলতেন- আয় বুঝে ব্যয় কর।
বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যেহেতু ডলারে পেমেন্ট করতে হয়, তাই ঋণ গ্রহণে সতর্কতা ও যৌক্তিকতা দুটোই থাকতে হবে।
দেউলিয়া হওয়া বিষয়ে আলোচনার আগে জানতে হবে একটা দেশের ডলার উপার্জনের উপায়গুলো সম্পর্কে।
১. রপ্তানি আয় থেকে:
ডলার উপার্জনের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় উপায় হলো রপ্তানি। রপ্তানি আবার মোটা দাগে তিন ধরণের, যেমন- পণ্য রপ্তানি, সেবা রপ্তানি এবং পুনঃ রপ্তানি। ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে দেউলিয়া হতে হলে প্রথমত এই রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে এখন থেকেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ কী? বিষয়টা এমন না যে, এই বছর রপ্তানি ভাল হয়নি তাই সরকারবিরোধী পক্ষগুলো এখনই আনন্দে মিষ্টিমুখ করা শুরু করবে; আর গলবাজি শুরু করবে যে- যাক বাবা অবশেষে বাংলাদেশ দেউলিয়া হলো।
আসল কথা হলো, দেশবিরোধীদের মনস্কামনা পূরণ হতে হলে অনেকগুলো বিষয় ঘটতে হবে। যেমন- এখন থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানির দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকতে হবে। এতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে বা আশানুরূপ হবে না। একে একে রপ্তানি বাজার হারাতে হবে। নতুন বাজার সৃষ্টিতে ব্যার্থ হতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রধান কোনো পণ্যে নিষেধাজ্ঞা পেলেও এমনটা হতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি আয় হয়েছে। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯.৭৩% বেশি এবং আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪.৩৮% বেশি। কিন্তু যদি দেউলিয়া হতে হয়, তবে রপ্তানিতে বাংলাদেশকে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়ে আগামী ২০২৪ পর্যন্ত এভাবে চলতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং উত্তরোত্তর বাড়ছে রপ্তানি, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন বাজার।
এ তো গেল পণ্য রপ্তানির কথা। বাংলাদেশ থেকে সেবা রপ্তানি হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পণ্য ও সেবা মিলিয়ে ৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। চলতি অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার। যদি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, রপ্তানি কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে এবং আগামী ২ বছর এভাবেই চলেছে, শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই দেউলিয়া হওয়ার মত একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
পুনঃ রপ্তানির হিসেবটা অন্যরকম। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির বিকাশ হয়েছে পুনঃ রপ্তানির মাধ্যমে। আরব আমিরাতের ক্ষেত্রেও। ব্যাপারটা হলো এমন যে, বাংলাদেশ কাঠ আমদানি করবে ক্যামেরুন থেকে। কিন্তু সেটা করবে সিঙ্গাপুরের মাধ্যেম। অনেকটা এমন যে, ক্যামেরুনের কাঠ আমরা কিনব সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে ক্যামেরুন থেকে কিনে আমাদেরকে সরবরাহ করবে।
বাংলাদেশ পুনঃ রপ্তানি বাণিজ্যে এখনো সেভাবে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। এজন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে, বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বিজনেস হাব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশি কোম্পানি ওমেরা ভারতের সেভেন সিস্টার্সে এলপিজি (লিকুইডিফাইড পেট্রলিয়াম গ্যাস) রপ্তানি করছে। এটি হল পুনঃ রপ্তানি। বাংলাদেশ এলপিজি উৎপাদন করেনা। ওমেরা বিদেশ থেকে তরল গ্যাস কিনে এনে আবার অন্য দেশে বিক্রি করছে। অনেকটা ট্রেডিং। উদাহরণটি দেওয়ার কারণ হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই গুজব ছড়িয়ে দাবি করছেন- দেশে গ্যাস নেই অথচ দেশের গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করছে। এটা সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। কিংবা জানতে না চাওয়ার প্রচেষ্টা অথবা, ইচ্ছেকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার প্রক্রিয়া।
২. রেমিট্যান্স থেকে আয়:
বাংলাদেশে ডলার প্রবাহ বৃদ্ধির দ্বিতীয় প্রধান মাধ্যম হলো রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যান এবং উপার্জনের অর্থ বৈধ উপায়ে দেশে পাঠান সেটাই রেমিট্যান্স। এখানে উল্লেখ্য, শুধুমাত্র বৈধ উপায়ে পাঠানো হলে তবেই সেটি রেমিট্যান্স। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হলে তাকে রেমিট্যান্স বলা যায় না। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে কোনো ডলার দেশে আসেনা। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১.১ বিলিয়ন ডলার।
উল্লেখ্য, বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স আসা কিছুটা কমে গেছে। যারা বৈধ উপায়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান শুধুমাত্র তারাই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তাদের অবদানে কোভিড-এর আর্থিক চাপ বাংলাদেশ নিতে পেরেছিল। প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নতুন করে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। এর কারণ একটাই- হুন্ডি। যদি এমন হয় যে, রেমিট্যান্স প্রবাহ একেবারেই কমে গিয়েছে, সেক্ষেত্রে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসা কমে যাবে। ফলে ট্রেড ডেফিসিট এড্রেস করা কঠিন হবে। এরুপ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকারে চললে দেউলিয়া হওয়ার অনেকগুলো কারণের একটি দেখা যেতে পারে।
কিন্তু ইতিমধ্যে সরকার বেশ কিছু দেশের সাথে চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করেছে। যার ফলে আরও কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। এতে রেমিট্যান্স খরা অচিরেই কমে যাবে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানোসহ আরও কিছু স্কিম হাতে নিচ্ছে সরকার। এতে উটকো দুশ্চিন্তাও কমে যাবে।
৩. দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ থেকে:
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এলে ডলার প্রবাহ বাড়ে। এই বিনিয়োগ আবার দুই ধরনের- একটা সম্পূর্ণ ফ্রেশ বা নতুন বিনিয়োগ, অন্যটি হল পুনঃ বিনিয়োগ। অর্থাৎ এদেশে যেসব বিদেশি কোম্পানি রয়েছে, তাদের বিনিয়োগ বা মুনাফা বিদেশে না নিয়ে দেশেই নতুন করে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশ যদি ঋণ নেয় তবে সেক্ষেত্রেও ডলার আসা বাড়বে। যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বাংলাদেশ চাইলেও ঋণ পাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে রপ্তানি, রেমিট্যান্স-এর বাজে পারফর্মের সাথে বিনিয়োগ এবং ঋণপ্রাপ্তি বন্ধের পরিস্থিতি যুক্ত হয়ে ২০২৪-এ বাংলাদেশের ভাগ্য বিরূপ হতে পারে।
এ তো গেল দেশে কীভাবে ডলার আসে তার হিসাব। এবার দেশ থেকে ডলার কীভাবে বেরিয়ে যায় সেই হিসেব করা যাক। বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে কি না, তার উত্তর পেতে হলে এ সম্পর্কে জানতে হবে।
১. আমদানি:
আমদানি বৃদ্ধির সাথে রপ্তানির একটি সম্পর্ক আছে। যেহেতু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক হল প্রধান রপ্তানি পণ্য, তাই রপ্তানির বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে আমদানিও বৃদ্ধি পায় কাঁচামালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই বলে। তবে বর্তমানে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের ভালো বিকাশ হয়েছে। ভ্যালু অ্যাডিশনও বেড়েছে। আগে দেখা যেত সুতা ও ফেব্রিক আমদানি করা লাগত। বর্তমানে সুতা ও ফেব্রিকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকাল মার্কেট থেকে নেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত বছর আমদানির পেছনে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার। যেখানে পণ্য রপ্তানি ছিল মাত্র ৫২ বিলিয়ন ডলার। আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের তেল বা গ্যাসের প্রাচুর্য নেই। ফলে তেল পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গ্যাসের ভেতর অভ্যন্তরীণ গ্যাসফিল্ড বাদে এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানি করা লাগে।
তেলের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা হলো, আমরা ক্রুড অয়েল আমদানি করতে পারি চাহিদার খুব অল্প অংশ। এর কারণ, আমাদের দেশে রিফাইনারি মাত্র একটি (ইস্টার্ন রিফাইনারি)। ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের সহায়তায় এর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কোভিডের কারণে মাঝে থমকে গিয়েছিল সব। এখন আবার এ নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
যেহেতু ক্রুড অয়েল বেশি পরিমাণে আমদানি করতে পারেনা বাংলাদেশ, ফলে আমাদেরকে বেশি দাম দিয়ে রিফাইন্ড তেল আমদানি করতে হয়। এতে ডলারের খরচ বৃদ্ধি পায়। আবার রিফাইন করার পর বাই প্রোডাক্ট পাওয়া যায় বিটুমিন। রিফাইনারি সক্ষমতা কম বলে আমাদের বিটুমিনও আমদানি করতে হয়। যদিও এখন দেশিয় প্রতিষ্ঠান বিটুমিন উৎপাদন করছে।
২. পর্যটন, চিকিৎসা ও বিদেশ সফর:
ডলার আসার ক্ষেত্রে পর্যটনের কথাটা উল্লেখ না করার কারণ হলো, এই খাতে আমাদের বিশেষ কিছু আয় হয় না। তবে ব্যায়ের ক্ষেত্রে বিশাল অংকের ডলার চলে যায় বাংলাদেশিদের বিদেশ সফরে। এক্ষেত্রে অবাক করার মত ব্যাপার হল, ভারতে সবচেয়ে বেশি বেড়াতে এবং চিকিৎসার জন্য যায় বাংলাদেশিরা। আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ আছে এই তালিকায়।
৩. বিদেশে বিনিয়োগ:
আমাদের প্রচলিত সিস্টেমে বিদেশে বিনিয়োগের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয়। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের (বৈধ উপায়ে) পরিমাণ অনেক কম। তবে অবৈধ উপায় রয়েছে অনেক। এক্ষেত্রে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। এটাও একটা বড় বিনিয়োগ। যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হয়, সেসব দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের। সেখানে তাদেরকে ডলার দেওয়া হলেই দেশে প্রবাসীর পরিবার বা ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা (ডলার নয়) পৌঁছায়, হাতে হাতে। এজন্য হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিপুল অর্থ (ডলার) বিনিয়োগের মাধ্যমে এই ব্যবসার স্ট্রাকচারটা দাঁড় করায়।
৪. ঋণের কিস্তি পরিশোধ:
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ডলার চলে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ঋণের কিস্তি পরিশোধ। বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে কি না- প্রশ্নের উত্তরটা এখানেই। যদি পরিশোধ করতে না পারে, তবে একটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়। প্রতি বছর ঋণের কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় কিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৪ সাল থেকে। মূলত এটাকে পুঁজি করেই বিএনপির পোষা বুদ্ধিজীবীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান না রেখে কিংবা জেনেশুনেই গুজবটা ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত কখনই লোন ডিফল্টার হয়নি, বরং অনেক সময় ডেডলাইনের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছে। এজন্যই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের প্রোফাইল বেশ ভালো।
এবার আলচনার মূল অংশে যাওয়া যাক। উপরোক্ত বিষয়গুলো অবতারণার উদ্দেশ্য হলো, অর্থনীতির ছাত্র নয়, এমন সাধারণ পাঠকরাও যেন পরিস্থিতি সহজে বুঝতে পারেন।
মূলত ব্যালেন্সিংয়ের ওপর নির্ভর করে সব কিছু। দেশ থেকে ডলার চলে যাওয়া এবং দেশে ডলার আসার মাঝে যদি বড় ধরণের অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, তখন বাফার হিসেবে কাজ করা রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময় আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। ফলে ব্যালেন্স অব ট্রেড সব সময় ঋণাত্মক থাকে। আর এখানে ব্যালেন্সিংয়ে সবচেয়ে বেশি কাজে আসে রেমিট্যান্স।
সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। এই চাপ সামলাতে গিয়ে টাকার দরপতন হয়েছে, রিজার্ভও কমেছে কিছুটা। যদিও রিজার্ভ কমেছে মূলত আমদানি বিল পরিশোধ করার জন্য। নিয়মিত এই বিল পরিশোধ করা একটি সচল প্রক্রিয়া। তবে আমাদের বর্তমান যে সক্ষমতা, তাতে খুব অস্বাভাবিক এবং বড় মাপের নেতিবাচক কিছু না ঘটলে ২০২৪-এ দূরে থাক, ২০৩০ সালেও বাংলাদেশের দেউলিয়া হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
খুব বেশি বাগাড়ম্বর মনে হচ্ছে? আসুন, একটা ফ্যাক্ট দেখা যাক। কিছু প্রিকশনারি অ্যাকশন বাংলাদেশ সময়ের আগেই নিতে পেরেছে। একটি হলো রেমিট্যান্সে প্রণোদন দেওয়া, যা প্রায় ৩-৪ বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। বর্তমানে সরকার যা করেছে, তা হলো, অহেতুক ডলার চলে যাওয়া রোধে অপ্রয়জনীয় এবং বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কঠিন করে দেওয়া। ট্যাক্স স্ট্রাকচারে পরিবর্তন না আনলেও ১০০% নিজস্ব উৎসের মার্জিন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আমদানির চাপ ইতোমধ্যে কমিয়ে দিয়েছে। তবে বিষয়টিকে যে ফুলপ্রুফ না হলেও লাগাম টেনে ধরার জন্য অনেকটাই কার্যকর।
তবে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এটা নিশ্চিত যে, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া ইতিমধ্যে চুক্তি করেছে যে, এখন থেকে খাদ্য রপ্তানিতে কোনো বাধা থাকবে না। সকল স্যাংশনের কারিগর এবং বিশ্ব মোড়ল খদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখন বলছে খাদ্যকে নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত করার জন্য। সম্প্রতি ইইউ’র দূত বাংলাদেশে এসে বলে গিয়েছেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করলেও তাদের আপত্তি নেই।
বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ:
বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। প্রতিটি দেশই ইনফ্লেশনের কবলে পড়েছে। যখন বিশ্বে ডিপ্রেশন বা রেসিশন শুরু হয়, তখন চাহিদা কমতে থাকে। পুনরায় মার্কেট কারেকশন হয়। উদ্ভুত পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও এটা আর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখবে না বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রিজার্ভের অর্থ টাকার মান ধরে রাখতে গেলে আর বাজারে ডলারের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে ব্যয় করলে রিজার্ভের দ্রুত পতন ঘটত। কিন্তু সরকারের অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপের ফলে এটা নিয়ন্ত্রিত উপায়ে করা সম্ভব হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আপাতত দেউলিয়া শব্দটা আমরা ভুলে যেতেই পারি। সুসংবাদ হলো, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য (গম) কিনবে বলে আলোচনা চলছে। সাপ্লাই চেইন নরমাল হলে এই যাত্রায় শঙ্কার মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু কালো মেঘ দেখা যাবে পোষা সেসব বুদ্ধিজীবীদের মুখে।
যদি সব কিছু একসাথে ক্রাশ করে, তবে কী ঘটবে:
শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক, গরু মরল। অর্থাৎ বাংলাদেশ ২০২৪-এ দেউলিয়া হওয়ার মত সত্যিকারের ঝুঁকিতে পড়েছে। পেমেন্ট ব্যালেন্স ঘাটতি ৩০-৪০ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে কেউ আর ঋণ দিতে চাইছে না। রপ্তানি ঋণাত্মক। রেমিট্যান্স আসা বন্ধ। সেক্ষেত্রে কী ঘটবে?
আদৌ যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। শুধুমাত্র রেমেট্যান্সে ৫-৬% প্রণোদনা দেয়া হলেও ডলারের ঘাটতি কাটানো যাবে। কারণ রেমিট্যান্সে যা আসে, এর চেয়ে হুন্ডি হয় ২-৩ গুণ বা আরো বেশি। তাই অধিক প্রণোদনা দিলে এই চাপ নিরসন করা সম্ভব।
সবশেষে একটি বিষয় না বললেই নয়। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উচিৎ একটু সচেতন হওয়া। কিছুটা পড়ালেখা করা। গুজবে কান না দেওয়া। দিনভর কে কয়টা বিয়ে করলো, কার সাথে কার ছাড়াছাড়ি হলো- এসব সংবাদের পেছনে অহেতুক সময় নষ্ট করার পর হুট করে ঋণ, জিডিপি, রিজার্ভের মত স্পর্শকাতর ইস্যুতে কিছু গালভরা বুলি কপি-পেস্ট করে ছড়ানো বন্ধ করা উচিত। নিজে যেটা বুঝেন না, তা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত ও দেশবিরোধীদের সৃষ্ট মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেশটাকে আর অস্থিতিশীল করবেন না দয়া করে।
নিজের দেশের সক্ষমতা সম্পর্কে জানা উচিত সবার। স্পর্শকাতর ইস্যুতে দেশকে দেউলিয়া করার কথা বলা উচিত নয়। জাতি হিসাবে নিজেদের মোরাল দুর্বল করার মানে নেই। সংবাদপত্রগুলোর উচিত কলামিস্টদের গাঁজাখুরি বক্তব্য প্রকাশ এবং ক্লিকবেইট টাইপ শিরোনাম করার পূর্বে দেশের কথা ভাবা।