মুক্তমঞ্চ:
বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে বিদেশিদের মধ্যে বেশি জড়িত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। মুজিব হত্যার ৫ দিনের মাথায় ২০শে আগস্ট খুনি মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে প্রতিহিংসাপরায়ণ কিসিঞ্জার এতটাই উল্লসিত হন যে, তিনি বলেন- “মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে আমরা নিজেকে ধন্য মনে করছি।”
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন ডিসক্লোজড নথিপত্র থেকে অকাট্য প্রমাণ মিলেছে, মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে কিসিঞ্জার সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। খুনিদের প্রতিও যথেষ্ট সহানুভূতি দেখান কিসিঞ্জার।
কিসিঞ্জার আরও বলেন, “স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে বার্তা পৌঁছানো, যাতে তারা ভরসা পায় যে, আমরা তাদের চাহিদার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবো। তাদের স্বীকৃতি দেব।”
স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শুক্রবার ভোর রাতে পরিবারের সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত এবং সুবিধাভোগী দেশগুলোর প্রতি আজও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ ঘৃণা জানায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্থান এবং তাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে নিজের দেশকে স্বাধীন করে ১৯৭১ সালেই ❛মুজিব❜ বিশ্ব নেতায় পরিণত হন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের কাছে শুধু পাকিস্থান পরাজিত হয়নি, খোদ যুক্তরাষ্ট্রও পরাজিত হয়েছিল।
৭১-এর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা ফারল্যান্ড ৩২ নম্বর বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। দেশি-বিদেশি অনেকেরই ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু ওইদিন রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। ফারল্যান্ড আমেরিকার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, পাকিস্থান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক এটা তারা চান না। কিন্তু মার্কিন হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে শেখ মুজিব তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে প্রকারান্তরে দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন।
হেনরি কিসিঞ্জার ৭১-এর সেই লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা ভুলতে পারেননি। ৭৫-এ জিয়া-মোশতাক চক্রের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যসহ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় কিসিঞ্জার-ভুট্টো চক্র। সেই কালরাতে বিশ্বের নিপীড়িত শক্তির পক্ষে সোচ্চার ❛মুজিব❜-এর কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ করে দেয় পরাজিত শকুনেরা। এদেশিয় খুনিদের মাথার ওপর ছায়া হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্থানসহ সুবিধাভোগী কয়েকটি পক্ষ।
কিসিঞ্জার ও তার দোসররা ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার চরম বিরোধিতা করেন। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী ও বিশেষ সহকারী তাহের উদ্দিন ঠাকুর গোপনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শলাপরামর্শ করেন কিসিঞ্জার গং-এর সঙ্গে। এমনকি কলকাতায় তাদের সাথে সিআইএ এজেন্টদের বৈঠকের খবরও পরবর্তীতে উঠে এসেছে বিভিন্ন নথিপত্রে। কলকাতায় বসে চালানো মোশতাকের অপতৎপরতার খবর ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরের পর তাকে আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। সেই অপমান মোশতাক ভুলতে পারেননি।
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার- ১৫ই আগস্টের পর মোশতাককে রাষ্ট্রপতি করা হলেও কিসিঞ্জার-ভুট্টো চক্রের পছন্দের আসল লোকটি ছিলেন জিয়াউর রহমান। মোশতাক ছিল কয়েকটি ঘুঁটির একটি। মুজিব হত্যার পর সেনাবাহিনীকে সামাল দেয়ার জন্য আইএসআই’র চৌকস কর্মতর্কা জেনারেল জিয়াকে তাদের প্রয়োজন ছিল। আর কৌশলগত কারণেই ১৫ই আগস্ট জিয়াকে প্রেসিডেন্ট করা হয়নি। জিয়া প্রেসিডেন্ট হলে সবাই ধরে নিত জিয়া চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সফল হতো না।
মোশতাককে ডামি হিসেবে ১৫ই আগস্ট ক্ষমতায় বসানো হয়। তবে মাত্র ৩ মাসের মাথায় মোশতাককে সরিয়ে জিয়াকে ক্ষমতায় আনা হয়। বিদেশি কয়েকজন প্রখ্যাত সাংবাদিক, মার্কিন ডিসক্লোজড (অবমুক্ত) দলিল এবং লরেন্স লিফশুলজের গবেষণায় উঠে এসেছে মুজিব হত্যায় জিয়াউর রহমানের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের কথা।
২০১১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে লিফশুলজ বলেন, “আমার অভিমত, জিয়া তার ব্যক্তিগত কারণেই ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটি ছিল তারই এজেন্ডা, যা তিনি ও অন্য কিছু অফিসার জানতেন। কেননা আমি বিশ্বাস করি, জিয়ার সুস্পষ্ট সমর্থন ছাড়া মুজিব হত্যাকাণ্ড সফল হতো না, এমনকি তারা এগুতেই সাহস পেতো না। তাইতো জিয়াই এই হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ছায়া মানুষ। নেপথ্যে থেকে পুরো কলকাঠি নেড়েছেন তিনি।”
বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িতদের নাম আবার উঠে এসেছে মার্কিন অবমুক্ত করা দলিলে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাড়ে তিন দশক পর অবমুক্ত করা এই মার্কিন দলিলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দৈনিক প্রথম আলোতে ২০০৯-এর ১১ই আগস্ট থেকে ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত ৮টি সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। মিজানুর রহমান খান এই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে হত্যা-ষড়যন্ত্রের সময় মার্কিন প্রশাসনে কর্মরত কোনো কোনো কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছেন। তবে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এসব তথ্য এর আগে ২০০৮ সালের ১৩ই আগস্ট থেকে ২৩শে আগস্ট পর্যন্ত ১০টি পর্বে দৈনিক সমকালেও প্রকাশিত হয়।
সপরিবারে বাঙালি জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকায় ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার ও জুলফিকার আলী ভুট্টো। এসব দলিলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন কিসিঞ্জার। ১৫ই আগস্ট ভোররাতে যখন ৩২ নম্বর বাসভবনে হত্যাকাণ্ড চলছে- সেই মুহূর্তেও সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিসিঞ্জার পুরো অপারেশনের খোঁজখবর রাখছিলেন।
মোশতাক-জিয়ার লেলিয়ে দেয়া সেনাসদস্যরা ২টি ইউনিট নিয়ে স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, বাসভবনের কর্মচারী, প্রহরীদেরসহ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ওইদিন ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কজন কর্মকর্তা নিয়ে স্টাফ সভায় বসেন। ঢাকার খবর জানার জন্য উদগ্রীব কিসিঞ্জার বৈঠকের শুরুতেই বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলব। নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বলেন, এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান।
কিসিঞ্জার তখন জানতে চান, মুজিবুর কি জীবিত না মৃত? আথারটন বলেন, মুজিব মৃত। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠসহ পরিবারের কজন সদস্য, ভাই, ভাগ্নে নিহত হয়েছেন। কিসিঞ্জার এই সভায় বসার আগেও ওই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার বলেন, আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে আরও ‘ভালো খবর’ পেয়েছি।
তিনি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছেন। তবে তাদের কথাবার্তা ফোনে নাকি সরাসরি হয়েছে তা তিনি বলেননি। কিসিঞ্জারের সেই ‘ভালো খবর’ হচ্ছে আমাদের জাতির পিতাকে হত্যার খবর।
ব্যুরো পরিচালক উইলিয়াম জি হিল্যান্ড কিসিঞ্জারকে জানান, আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছি, তখনও তিনি (শেখ মুজিব) নিহত হননি। কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, আচ্ছা? তারা কি কিছু সময় পর তাকে হত্যা করেছে? এর জবাবে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন বলেন, “আমরা যতদূর জানি- আমি বলতে পারি না যে, আমরা বিস্তারিত সবকিছু জেনে গেছি। কিন্তু ইঙ্গিত ছিল তাকে হত্যা-পরিকল্পনা বিষয়েই। তারা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাকে হত্যা করে।”
ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে স্টাফ সভায় মিলিত হওয়া এবং তারও আগে মুজিব হত্যা সম্পর্কে আথারটনের সঙ্গে কিসিঞ্জিারের তৎপরতা থেকে বোঝা গেল যে, ওই রাতে কিসিঞ্জার ঘুমাননি। নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টার মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ছিলেন। তিনি তার উর্ধ্বতনদেরকে ঢাকা থেকে বেশ কিছু তারবার্তা পাঠান সেই রাতে। বাংলাদেশে মোশতাক, জিয়া, ফারুক-রশীদ চক্র তাদের বিদেশি প্রভুদের ভৃত্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
বোস্টার গং ঢাকায় খুনি চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। এমনকি ১৫ই আগস্ট ভোররাতে হত্যাযজ্ঞ চলাকালে ঢাকার রাজপথে বোস্টারকে তার গাড়িতে ঘুরতে দেখা গেছে। সোজা কথায়, হাজার মাইলের পথ সুদূর ওয়াশিংটন থেকে কিসিঞ্জার এবং ঢাকা থেকে বোস্টার মুজিব হত্যাকাণ্ড সরাসরি তদারকি করেছেন। তারপর বোস্টার ঘন ঘন বার্তা পাঠিয়ে ঢাকার পরিস্থিতি ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন। মার্কিন দূতাবাস তাদের বার্তায় ঘাতক চক্র কর্তৃক বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেছে।
তবে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার পর জারিকৃত কারফিউ উপেক্ষা করে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না হওয়াটা ঢাকা থেকে প্রেরিত মার্কিন বার্তায় বারবার উঠে এসেছে। বোস্টার ওই দিন আরেকটি বার্তায় লিখেছেন: “ঢাকায় এখন বিকেল ৪টা। তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই অভ্যুত্থান সফল। রাস্তাগুলো শান্ত, লোক চলাচল খুবই কম, যানবাহন নেই বললেই চলে, দুঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল ছিল এবং রাস্তায় সেনাদের সশস্ত্র টহল রয়েছে।”
১৬ই আগস্ট বোস্টার আরেক বার্তায় খন্দকার মোশতাককে মার্কিনপন্থী হিসেব উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে দৃশ্যত যে দুজন বিদেশি উল্লসিত হন, তাদের একজন হলেন কিসিঞ্জার, অন্যজন পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। স্বাধীনতার দুবছর পর বাংলাদেশকে পাকিস্থান স্বীকৃতি দেয় (বঙ্গবন্ধুর চালে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের চাপে বাধ্য হয়েছিল দিতে)। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোশতাকের অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘাতক সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেন ভুট্টো।
পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামিক রিপাবলিক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য তৃতীয় বিশ্ব এবং ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। খুশিতে ডগমগ ভুট্টো ১৫ই আগস্ট আরও ঘোষণা করেন, পাকিস্থান শীঘ্রই বাংলাদেশে ৫০ হাজার টন চাউল, ১ কোটি গজ মোটা কাপড় এবং ৫০ লাখ গজ মিহি কাপড় উপহার হিসেবে প্রেরণ করবে।
মার্কিন অবমুক্ত দলিলে বলা হয়, মুজিব হত্যার পর ভুট্টোর উত্তেজনা এতটাই তীব্র হয়েছিল যে, তিনি বাংলাদেশের নাম পালটে ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাখেন এবং শিশু ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে বাঁচাতে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানান। কিন্তু ১৬ই আগস্ট ঢাকা বেতার দেশের নাম পরিবর্তনের কথা অস্বীকার করে। এর পরেও ভুট্টো হাল ছাড়েননি। মোশতাক সরকারের প্রতি দূতিয়ালি করতে তিনি সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব সফর করেন।
তবে ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কথা ভুট্টো আগে থেকেই জানতেন। ১৯৭৫-এর জুনে কাবুলের পাকিস্থান সামরিক একাডেমিতে ভুট্টো বলেন, এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। (জুলফিকার ভুট্টো অব পাকিস্থান, স্ট্যানলি ওলপার্ট)। ভারতকে তাদের কথিত হস্তক্ষেপ থেকে নিষ্ক্রিয় রাখতে বাংলাদেশের খুনি চক্র এবং পাকিস্থানের ভুট্টো মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে ঘন ঘন ধর্না দিচ্ছিল। কিন্তু ওদের আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেননি বোস্টার। একটিবারের জন্যও বোস্টার বলেননি, ভারত হস্তক্ষেপ করলে যুক্তরাষ্ট্র তা ঠেকিয়ে রাখবে।
৭ই নভেম্বর কথিত সিপাহি বিপ্লবের দিনে জেনারেল জিয়া ভারতীয় হামলা ঠেকিয়ে রাখতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিবকে সকালেই মার্কিন দূতাবাসে প্রেরণ করেন। দুপুরে মোশতাকের মুখ্য সচিব মাহবুব আলম চাষী সরাসরি ফোন করেন বোস্টারকে। অনুনয় একটিই- ভারতকে ঠেকান। কিন্তু ভারতজুজু ছড়ানো যে বাস্তব ছিল না, কৌশলগত ছিল, তা স্পষ্ট করেন বোস্টার স্বয়ং। ওই সময় ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন হামলায় আহত হলে দুদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। জিয়াউর রহমান তখন সাহায্যের জন্য আবার মার্কিন সরকারের কাছে ধর্না দেন।
মিজানুর রহমান খান লিখেছেন:
প্রাপ্ত মার্কিন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, “জেনারেল জিয়াউর রহমান সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনকে একান্ত আপন মনে করেছিলেন। ৭ই নভেম্বর জিয়া ক্ষমতা নিয়েই তার দূতকে বোস্টারের কাছে পাঠান। ব্যক্তিগত শুভেচ্ছার জবাবে বোস্টার এ সময় জিয়াকে পুরনো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন। বার্তাটি ছিল এরকম: বাংলাদেশটা পাকিস্থানপন্থী, ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে গেছে।
ভারত এখন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এটা ঠেকাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চাই। ১৯৭৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ৮১ দিনের মাথায় ক্ষমতা নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রথম বার্তা।” (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬.৮.২০০৯)।
জেনারেল জিয়া ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর থেকেই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন শুরু করেন। আর ক্ষমতা নিয়েই ভারতজুজুর ভয়ে ভীত জিয়া মার্কিন সরকারকে জানান দেন- বাংলাদেশ পাকিস্থানপন্থী, ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে গেছে। এই একটিমাত্র বাক্য থেকেই বোঝা যায়, বীরোত্তম খেতাবধারী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন অনুপ্রবেশকারী ছিলেন।
অবমুক্ত দলিলে বলা হয়, ১৯৭২ সালেই মেজর ফারুক রহমান রহস্যজনকভাবে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১১ই জুলাই রশীদও একইভাবে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সেখানে যান। রশীদ সে সময়ের ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির পক্ষে সেখানে গিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার দুবছরের মাথায় মুজিববিহীন বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা প্রতিহত করতে ফারুক-রশীদ ও জিয়াউর রহমান আলাদাভাবে সেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই সামরিক সহায়তার জন্য ধর্না দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি জিয়াউর রহমান যে গোড়া থেকেই হত্যা-ষড়যন্ত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, অবমুক্ত মার্কিন দলিলে তা আবারও প্রমাণিত হলো।
অবমুক্ত দলিল অনুযায়ী ২রা নভেম্বর মধ্য রাতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সময় মোশতাকসহ ফারুক-রশীদ চক্র সূর্যাস্তের আগেই পালাতে চেয়েছিল। মোশতাক গং মার্কিন হেলিকপ্টারে চড়েই যুক্তরাষ্ট্রে পালাতে আবদার করেছিলেন। কিন্তু বিমান দিতে রাজি না হলেও খুনিদের আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ৫ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালের বোস্টারের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় (২৬১৭৮৫) নির্দেশনা দেন- “আপনি রাষ্ট্রপতি মোশতাককে অব্যাহতভাবে এই নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন রয়েছে। আপনি মোশতাককে এটা জানিয়ে দিতে পারেন- তিনি যদি আসতে চান তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বাগত জানাবে। তাকে এটাও জানাতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন তার জীবনের নিরাপত্তাজনিত হুমকি অত্যাসন্ন, তাহলে অস্থায়ীভাবে দূতাবাসে আশ্রয় দিতে আমরা প্রস্তুত থাকবো।” (দৈনিক প্রথম আলো, ১৩.৮.০৯)।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতা হওয়ায় ৪ঠা নভেম্বর সন্ধ্যায় মোশতাক ছাড়া ১৫ই আগস্টের অন্য খুনিরা ঢাকা ত্যাগ করে থাইল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। বোস্টার সেই বার্তা কিসিঞ্জারকে ৫ই নভেম্বরই পৌঁছে দেন। তিনি লিখেছেন, “আমি বেলা দেড়টায় রাষ্ট্রপতিকে ফোন করি। কিন্তু ফোন ধরেন চাষী। বলেন, রাষ্ট্রপতি এখন ফোন ধরতে অপারগ।” তবে লক্ষণীয়, ফারুক-রশীদ গং চলে যাওয়ার পরও চাষীকে বলেন বোস্টার- বাংলাদেশ ত্যাগের আগে দরকার হলে রাষ্ট্রপতি ও তার সহযোগীরা দূতাবাসে থাকবেন। চাষী তাকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
৬ই নভেম্বর বিচারপতি সায়েম নয়া রাষ্ট্রপতি হন। মোশতাক ও তার সঙ্গীরা বঙ্গভবন ছেড়ে যার যার বাসভবনে চলে যান। খুনি চক্র ২৪শে নভেম্বর থাইল্যান্ড থেকে লিবিয়া রওনা হয়। লিবিয়া রওনা হওয়ার ৪ দিন আগে ফারুক থাইল্যান্ডে মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে। মার্কিন অবমুক্ত দলিলের শেষপর্বে বলা হয়- “এই প্রথম স্পষ্ট জানা গেল, কৌশলগত কারণে ফারুক-রশীদকে পাকিস্থান সরকার রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি। তবে তারা ভেঙে যাওয়া পাকিস্থান একত্র করতে কাজ করেছিল।” (দৈনিক প্রথম আলো, ১৮.৮.০৯)।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মুজিব হত্যার ৮১ দিনের মাথায় ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আগস্ট চক্রান্তের প্রধান হোতা- জিয়াউর রহমান। এরপর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৮১ সালের ৩০শে মে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্থান বানানোর লক্ষ্য নিয়েই ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। কিসিঞ্জার-ভুট্টো-সৌদি-চীন চক্র স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি।
ড. কিসিঞ্জারের প্রাক্তন স্টাফ অ্যাসিসট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবের প্রতি কিসিঞ্জারের তীব্র ঘৃণার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানিয়েছেন- “কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকায় ৩ জন সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছেন- আলেন্দে, থিউ ও মুজিব।” মরিস বলেন, “মুজিব ক্ষমতায় আসেন সব কিছু অগ্রাহ্য করে। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্থানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।” (দি আনফিনিশড রেভিল্যুশন, লরেন্স লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ১৩৭-১৩৮)।
সর্বশেষ মার্কিন অবমুক্ত দলিলেও প্রমাণিত হলো পাকিস্থান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কারণেই শেখ মুজিব ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হচ্ছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২০১৩ সালে মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড নামে একটি বই লিখেছেন। এই বই থেকে জানা যায়, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই দেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বিচারের দাবি উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাংবাদিক কিসিঞ্জারকে যুদ্ধাপরাধী এবং বিচিত্র মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড গ্রন্থে মিজানুর রহমান খান লিখেছেন- “মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্স ২০০১ সালে তার দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে লিফশুলজের বরাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএর সম্পৃক্ততার বিষয়টি সমর্থন করেন। হিচেন্স চার দশকের বেশি সময় সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে জড়িত ছিলেন।
হিচেন্স লিখেছেন: “বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কিসিঞ্জার রাজনীতির বিষয়টাকে একটি নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে নিয়ে প্রতিশোধ পরায়ণতা দেখিয়েছেন। তার কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কিছু ব্যক্তির কথাও আমরা জানি। যাদের মধ্যে রয়েছেন- সালভাদর আয়েন্দে, আর্চ বিশপ ম্যাকারিওস ও শেখ মুজিবুর রহমান।” (পৃষ্ঠা ২০-২১)
কোনো আদালতে কিসিঞ্জারের বিচার হবে কি না সন্দেহ। তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।
লেখক: মোহাম্মদ শাহজাহান
বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক; সাংবাদিক