জিয়ার রাজনৈতিক পাপ ও করুণ পরিণতি : ইতিহাসের দায়মোচন

0

বিশেষ প্রতিবেদন:

১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনা সদস্যের হাতে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হন। চার দশকেও বিএনপি টিকে আছে এবং দুই দফা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জিয়ার অবস্থান আজ কোথায় এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।

রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার যে নীতি ও কৌশল, সে কৌশলে জিয়াউর রহমানের রাজনীতিই এখন সংকটাপন্ন। জাতীয় রাজনীতিতে জিয়া এখন খলনায়ক। বিএনপির রাজনীতিতে জিয়া এখন পার্শ্বচরিত্র। ইতিহাসে জিয়া এখন এক পরিত্যক্ত অধ্যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়ার উত্থান ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ পন্থায়। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। এ হত্যাকান্ডে নিষ্ক্রিয়, নির্মোহ থাকা ছিল রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের প্রথম পাপ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়া খুনিদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন।

একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল সেনাপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতি অথবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানানো। এটা জানালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। জিয়া সব জেনে তাদের সম্মতি দিয়ে কার্যত ’৭৫-এর ক্যু-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কেন এটা জিয়া করেছিলেন এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যেতে হয়।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা ছিল রহস্যময়। এ সময় তাকে লেখা পাকিস্থানি সেনা কর্মকর্তার চিঠি থেকেও বোঝা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলেও জিয়ার সঙ্গে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর গোপন যোগাযোগ ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জার্মানরা বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে তাদের ‘এজেন্ট’ রাখত। যারা প্রয়োজনে এমন কাণ্ড ঘটাতো যাতে লাভ হতো নাৎসিদের। জিয়াউর রহমান কি সে রকম কোনো এজেন্ট ছিলেন? এ নিয়ে এখন বেশ কথাবার্তা চলছে।

ইতিহাসবিদরা বলেন, ’৭১-এ জিয়াউর রহমানসহ পাকিস্থান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনা সদস্যদের ব্যাপারে আরও বিশদ গবেষণা হওয়া দরকার। এদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে কেন এসেছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর এসব প্রশ্নের সঠিক এবং গবেষণানির্ভর উত্তর অত্যন্ত জরুরি।

’৭৫-এর খুনিদের বেশ কয়েকজন ’৭১-এর তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্থান থেকে পালিয়ে এসে এরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে, যখন পাকিস্থানের পরাজয় প্রায় সন্নিকটে। শুধু যোগ দেননি তারা, বিশেষ বিবেচনায় কেউ কেউ খেতাবও পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান না রেখেও।

তবে এটাও ঠিক যে, অনেকেই জীবন বাজি রেখে পালিয়ে এসে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। তারা রণাঙ্গনে বীর বিক্রমে লড়েছেন, শহিদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন; বীরত্বসূচক খেতাব দূরে থাক, অনেকে বহু কষ্টে দিন-যাপন করেছেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদ, ফারুক, ডালিমরা কি তাই ছিল? নাকি তাদেরকে পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা- আইএসআই পাঠিয়েছিল বিশেষ মিশন দিয়ে, ভিতরে ঢুকে সর্বনাশ করতে। সামরিক বিজ্ঞানে বলে, যুদ্ধজয়ই শেষ কথা নয়। যুদ্ধের পরও যুদ্ধ থাকে। পাকিস্থান সেই গোপন যুদ্ধ আজও চালিয়ে যাচ্ছে। এ যুদ্ধে পাকিস্থানের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা।

পাকিস্থান একাত্তরে পরাজয়ের পর আশা করেছিল বাংলাদেশ টিকবে না। বাংলাদেশ আবার পাকিস্থান না হোক, কনফেডারেশন হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আইএসআই অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। যারা সে সময় পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে এসেছিল, তাদের কেউ কেউ যে পাকিস্থানের এজেন্ট ছিল তা আজ প্রমাণিত। এরা পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজেই ব্যস্ত ছিল।

পাকিস্থান জানত, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে বাংলাদেশকে আর পাকিস্থান বানানো সম্ভব নয়। এজন্যই ’৭৫-এর নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। আর ওই হত্যাকান্ডের ঘাতকদের প্রায় সবাই পাকিস্থান প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা। এদের সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও উন্মোচিত। তাই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর চার দশক পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জিয়া কি মুক্তিযোদ্ধা নাকি মুক্তিযোদ্ধার বেশে পাকিস্থানি এজেন্ট?

এই প্রশ্ন প্রবল এবং তীব্র হয় ’৭৫-পরবর্তী জিয়াউর রহমানের কর্মকান্ডে। ৭ই নভেম্বর ক্যু-পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন জিয়া। জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল তাহের। কিন্তু জিয়া তার সঙ্গেও বেইমানি করেন। জিয়াই যে তাহেরকে হত্যা করেছেন, তা আজ আদালতের রায়েই প্রমাণিত। এরপর জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, পাকিস্থানের পক্ষে।

জিয়া সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র উপড়ে ফেলেছিলেন। জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে ঢুকিয়ে রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে বের করেছিলেন। গোলাম আযমের মতো ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধের শিরোমণিকে দেশে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। শাহ আজিজের মতো স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন জিয়া।

এ রকম অপকর্মের ফিরিস্তি দিলে তা অনেক দীর্ঘ হবে। এখানে শুধু জিয়ার রাজনৈতিক প্রবণতা উল্লেখ করা হলো। তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্থান বানানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এমনকি ‘বাংলাদেশ বেতার’-কে রেডিও বাংলাদেশ বানানোর মতো ছোটখাটো বিষয়েও তার নজর এড়ায়নি।

কিন্তু এসব করেও যেন জিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন পুরোপুরি হচ্ছিল না। জিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেছিলেন। তাহেরের সঙ্গেও করেছেন- যে তাহের সৈনিকদের রোষ থেকে জিয়ার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৮শে অক্টোবর বিচারপতি সায়েমের সঙ্গেও বেইমানি করেন জিয়া। বঙ্গভবনে ডেকে অস্ত্রের মুখে তাকে হটিয়ে নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।

জিয়ার রাজনীতির মূল অনুষঙ্গ অবশ্য এই ‘নাফরমানি’। জনগণের সঙ্গেও জিয়া বেইমানি করেছিলেন। ’৭৫-এর ১১ই নভেম্বর জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই এবং আমার সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।

এই বক্তব্যটাও ছিল প্রতারণা। জিয়া সামরিক পোশাকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন, ছাত্রসংগঠন তৈরির চেষ্টা, জাগদল গঠন প্রক্রিয়া শেষে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। সেনাপ্রধান একজন সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি করে রাজনৈতিক দল গঠন, নির্বাচন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন।

’৭৫-এর ৭ই নভেম্বর থেকে ’৮১-এর ৩০শে মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে জিয়াই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ সময়ে তার কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিয়া একদিকে পাকিস্থান বানানোর নীরব প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যদিকে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন।

একটি রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। বাংলাদেশে ভৌতিক ভোট সংস্কৃতির সূচনা করেছিলেন জিয়া। আগে ভোট নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হতো। আবার এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর কারচুপির অভিযোগ আনত। কিন্তু জিয়াউর রহমান গায়েবি ভোটের এক অভূতপূর্ব সংস্কৃতি চালু করেন।

১৯৭৭ সালের ৩০শে মে জিয়া হ্যাঁ/না গণভোটের আয়োজন করেন। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ একটি ঢাউশ সাইজের গ্রন্থ লিখেছেন জিয়ার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে। ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ; এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ শিরোনামে ওই গ্রন্থের ৭১ পৃষ্ঠায় বিস্ময়কর এ ভোট বিপ্লব নিয়ে জিয়াও যে হতবাক হয়েছিলেন তা উল্লেখ করা হয়েছে।

জিয়া তার সমর্থনে ওই গণভোটে ৯৮.৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন! বিরোধী দলের ওপর দমন-নিপীড়ন। বিরুদ্ধমতকে হত্যা, ভয় এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেই জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন। বিদেশি ঋণনির্ভর অর্থনীতি, খাদ্য ঘাটতি রাখার কৌশল ছিল বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে পঙ্গু করার নীরব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, জিয়া কেন এসব করেছিলেন? এটা কি অদক্ষতা না পরিকল্পিত? এ প্রশ্নের উত্তরে সাদামাটাভাবে বলা যায়, জিয়া আসলে ছিলেন পুতুল। পাকিস্থানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার তা-ই তিনি করেছেন। পাকিস্থান আমলে যেমন উগ্রবাদী এক সফল প্রচারণা চালানো হতো যে, ভারতবিরোধিতা মানেই দেশপ্রেম। জিয়াউর রহমান খুব দক্ষতার সঙ্গে সেই চেতনা ফিরিয়ে আনেন। প্রচার-প্রচারণায় ভারতবিরোধিতা করে দেশপ্রেমের আলখাল্লা পরেন জিয়াউর রহমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পাকিস্থানি ধারা ও সংস্কৃতির সফল অনু-প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন জিয়া। জিয়া নিজেই বলেছিলেন, ‘রাজনীতি ডিফিকাল্ট’ করবেন। রাজনীতি ডিফিকাল্ট করতে গিয়ে জিয়া সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে যথেচ্ছভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। কালো টাকা, অস্ত্র, মস্তান দিয়ে রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করেছেন।

রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হিসসা দিয়েছেন। পাকিস্থানি দুর্নীতিগ্রস্ত খিচুড়ি রাজনীতির মডেল জিয়া সফলভাবেই বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন করেছেন। সে সংস্কৃতি থেকে এখনো বাংলাদেশের রাজনীতি বেরোতে পারেনি।

একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু আর ১০টা বছর দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিলে বাংলাদেশ উন্নত আধুনিক এক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াত। ঠিক একইভাবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান আর ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ অবিকল একটি ‘পাকিস্থান’ হতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সস্তা রাজনৈতিক সমালোচনায় জিয়াকে মর্যাদাবান করা হয়েছে।

বাংলাদেশে জিয়াকে নিয়ে একটি নির্মোহ গবেষণা হওয়া দরকার ছিল। আওয়ামী লীগের সমালোচনার জবাব দিতে জিয়াবন্দনার মাত্রা বাড়িয়েছে বিএনপি। জিয়াকে হলিউডি চলচ্চিত্রের র‌্যাম্বো বা ডিসি/মারভেল-এর সুপারহিরো দাবি করে তার দল।

’৮১-এর ৩০শে মে জিয়াউর রহমান মারা যান। এর পরেও জিয়ার রাজনৈতিক ধারা বন্ধ হয়নি। বিএনপি তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে জিয়াকে মহিমান্বিত করার এক অদ্ভুত রাজনীতি শুরু করে। জিয়া বাংলাদেশে আওয়ামীবিরোধী শক্তিকে একত্রিত করেছিলেন। উগ্র বাম ও উগ্র ডানকে তিনি ক্ষমতার ঘাটে জল খাইয়েছিলেন। ফলে তার একটা উগ্রবাদী সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল।

জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাজায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ। যারা পাকিস্থানে বিশ্বাস করে, যারা মুসলিম লীগের জন্য হাহাকার করে, রক্তাক্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যর্থতায় যারা হতাশ, যারা আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে তাদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন জিয়া। এরাই জিয়াকে সৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি নেতারা দুটি বিষয় আবিষ্কার করেন। প্রথমত, একটি রাজনৈতিক দলের যে আদর্শিক ভিত্তি তা বিএনপির নেই। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ক্ষমতার গর্ভে গড়ে ওঠা বহুমতের একটি ক্লাব। তাই এ দলকে টিকিয়ে রাখতে বিএনপি জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে খালেদা জিয়াকে সামনে আনে। আর তীব্র নাৎসি কায়দায় জিয়াবন্দনায় মনোযোগ দেয়।

লক্ষ্য করুন, জিয়াউর রহমান হলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার পুরো নাম। সহধর্মিণীরা সাধারণত স্বামীর নামের শেষ অংশ গ্রহণ করেন। তাহলে খালেদা জিয়ার নাম হওয়া উচিত ছিল খালেদা রহমান। ‘জিয়া’নির্ভর রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই খালেদার নামের পাশে জিয়া জুড়ে দেওয়া হয়। জিয়া কোনো পদবি নয়। জিয়ার বংশপদবি হলো রহমান। বিএনপিকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিল পাকিস্থানি এজেন্ডা। কারণ বিএনপি না থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্থানের স্বার্থ দেখবে কে?

তাই জিয়ার মৃত্যুর পরও বাংলাদেশে জিয়াবন্দনা বন্ধ হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রবল হয়। যেমন জিয়া নিজেকে কখনই স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করতে সাহস পাননি। বরং বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিজের লেখা একটা প্রবন্ধে জিয়া উল্লেখ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার ইঙ্গিত পান, লড়াইয়ের সবুজ সংকেত পান। সেই জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি নেতারা ‘ঘোষকতত্ত্ব’ আবিষ্কার করেন। নব্য গড্ডলিকা গবেষক তো জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতিও বানিয়ে ফেলল।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে পাকিস্থানপন্থিরা অনুসন্ধানে নামেন জিয়াকে কীভাবে অমরত্ব দেওয়া যায়; ঠিক অমরত্ব নয়, বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বকে ঢেকে বাঙালিত্বকে কবর দিতে গিয়ে জিয়াকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জাঁকিয়ে তোলা হয়।

জিয়ার পরিচয় একজন সেনা সদস্য, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন হিংস্র প্রতিশোধপ্রবণ একনায়ক। কিন্তু এই পরিচয় দিয়ে তো আর জিয়াকে অমর জাতীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া যায় না। এই ক্ষুদ্র আকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু নামক হিমালয়কেও আড়াল করা সম্ভব না, মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়া তো দূর কি বাত!

কাজেই বিএনপিপন্থি পন্ডিতরা ইতিহাস বিকৃতির পথে পা বাড়ান। জিয়া যা নন, যা ছিলেন না তা বলার এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু-কে ইতিহাস থেকে মুছতে না পেরে তার পাশাপাশি জিয়ার নাম বসানোর ঔদ্ধত্য দেখায় অনেকে। ২০০১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ জিয়ার মৃত্যুর দুই দশক পর্যন্ত জিয়া বন্দনাই ছিল বিএনপির রাজনীতির প্রধান উপজীব্য।

এ মাতম তুলেই আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিকে এক প্ল্যাটফরমে রাখে বিএনপি। দুবার ক্ষমতায় আসে। এর মধ্যে বিএনপিই প্রথম জিয়াকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে। বিএনপি প্রথম তাকে মূর্তি বানিয়ে সাজিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করে।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের উত্থান ঘটে। ওই নির্বাচনে বিপুল বিজয় বিএনপিকে বেসামাল করে। তারা মনে করে নতুন নেতা এসেছে, জিয়ার মেয়াদ ফুরিয়েছে। ২০০১ সালে শুরু হয় তারেকবন্দনা!

তারেক যেন এক মিনি জিয়া। জিয়ার মতো তারেক গ্রামগঞ্জে যাওয়া শুরু করেন। জিয়ার মতোই তারেক ভাঙা স্বরে, ধমক দিয়ে দিয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন। সানগ্লাস, কোমরে হাত, মাথায় ক্যাপ- তারেক নিজেই জিয়ার কার্বনকপি হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নকল শাহরুখ খান কি আর আসল শাহরুখ হয়? নকল জিয়াও তাই কেবল জিয়াকে নির্বাসিত করে, জিয়া হতে পারে না।

তারেক জিয়া এসে আদি জিয়াপন্থীদের নির্বাসনে পাঠাতে শুরু করেন। অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। জিয়ার ঘনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে বিদায় করা হয়। হাওয়া ভবন গড়ে বিকল্প নেতৃত্বের নামে বাবর-আমানদের দিয়ে তারেক নতুন বিএনপি বা সমান্তরাল বিএনপি গড়ে তোলেন।

বিএনপি নেতা-কর্মীরাও বুঝতে পারেন, জিয়াবন্দনা করে কোনো লাভ নেই, তারেকবন্দনা না করলে হালুয়া-রুটি পাওয়া যাবে না। ব্যস, শুরু হয় জিয়াকে সরিয়ে ফেলার প্রতিযোগিতা। বিএনপির কর্মসূচিতে জিয়ার ছবি ছোট হতে থাকে। বড় হয়ে উদ্ভাসিত হয় তারেক রহমানের ছবি। ‘ভাইয়া’ সংস্কৃতিতে প্লাবিত হয় বিএনপি।

জিয়া সম্পর্কে পাকিস্থানি প্রেসক্রিপশনে কিছু ‘মিথ’ ছড়ানো হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা গেছে, এসবের অধিকাংশই মিথ্যা। এসব মিথের মধ্যে ছিল, জিয়া সৎ। জিয়া তার আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেন না। কিছু কিছু মানুষের হৃদয়ের কোণায় ‘পাকিস্থান’ বসবাস করে, তারা এসব বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করতেন, আওড়াতেন।

নতুন বিএনপিতে তারা দেখলেন উল্টো চিত্র। তারেকের হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি-লুটপাট মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। খালেদা জিয়া তার ভাইবোন চৌদ্দগুষ্ঠিকে ক্ষমতার তবারক বণ্টন করলেন। ওই সব অন্ধ সমর্থকের মোহভঙ্গ ঘটল। তারা দেখলেন, এই বিএনপি সেই বিএনপি নয়।

তারেকের বিত্তবৈভবের বিপরীতে তারা ফজলে লোহানী আবিষ্কৃত ‘ভাঙা স্যুটকেস’ মেলাতে পারলেন না। আর এখান থেকেই নীরব সমর্থকরাও বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। স্বার্থের রাজনীতি বোধহয় এমনই।

তারেক পিতার ছায়া থেকে বেরোতে গিয়ে পিতাকেই নির্বাসনে পাঠালেন। ২০০৭ সালে বিএনপির মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘জিয়াউর রহমানের আদর্শচ্যুত হয়েছে বিএনপি। জিয়াকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়েছে।’ ফলে জিয়াউর রহমান তার মৃত্যুর ৪০ বছর পর কোথাও নেই। সংসদ ভবনের উল্টোপাশে তার সমাধিস্থলটাই শুধু টিকে আছে।

যদিও সেই সমাধি নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। কারণ মার্কিন গোয়েন্দা নথিপত্র বলছে, জিয়ার লাশ পুড়িয়ে হালদায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আর ঢাকায় আনা হয়েছিল চেহারা শনাক্তের উপায় নেই, এমন কমব্যাট ইউনিফর্ম পরা একটি মরদেহ।

একজন রাষ্ট্রপতি রাতে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে উঠে গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয় কমব্যাট ইউনিফর্ম পরে ঘুমাতে যাননি। সেই লাশের কফিন খোলা হয়নি, তার পোস্টমর্টেমও হয়নি। ‘আমার আব্বুকে দেখাও’ বলে তারেকের কান্নার পরেও কফিনের ঢাকনা না খুলে কবর দেওয়া হয়েছিল কোনো এক হতভাগ্য সৈনিকের মরদেহ।

আজ সেই সমাধি পীর বাবার মাজারে পরিণত হয়েছে। যে কোনো দিবস এলেই বিএনপি নেতারা সেই মাজারের শিন্নির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন সেখানে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ‘শহিদ জিয়া’ (আততায়ীর গুলিতে নিহত) শুধু কয়েকটা বাক্যে সীমিত হয়ে গেছে।

আত্মঘাতী রাজনীতির পরিণতির প্রামাণ্য বিজ্ঞাপন জিয়াউর রহমান। মৃত্যুর চার দশক পর জিয়া নির্বাসিত তার দলে-দেশে। এটাই ইতিহাসের মাধুর্য। ইতিহাস কখনো কাউকে যোগ্য স্থান দিতে কার্পণ্য করে না। ইতিহাসের প্রতিশোধ কত নির্মম তার প্রমাণ জিয়াউর রহমান।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।