বিশেষ প্রতিবেদন:
আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদ পূর্ণ করছে। ইতিমধ্যে তৃতীয় মেয়াদের ৩ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করেছে। সরকারের গত ১৩ বছরের বেশি শাসনামলে সবচেয়ে সাহসী এবং ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড গুলোর মধ্যে একটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির দাপট। আর এই দাপটের একটি বড় কারণ অনেকেই মনে করছেন জামায়াতের উপস্থিতি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত ছিল সব সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থনই শুধু করেনি, গোলাম আযম, নিজামী, সাইদী, মুজাহিদ, মীর কাসেম, কাদের মোল্লারা ৯ মাসের গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের পরিকল্পনাকারী এবং হোতা ছিল।
এ কারণেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাধিকবার জামায়াতকে একটি যুদ্ধাপরাধীদের ফ্যাসিস্ট সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। কিন্তু সংগঠন হিসেবে জামায়াত এখনও টিকে আছে। তাদের নেতা-কর্মীরা ভিন্ন নামে, ভিন্ন চেহারায় অন্য রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগেও।
রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, জামায়াতের কারণেই অন্যান্য ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো এখনো তৎপরতা চালাচ্ছে। যে সমস্ত জঙ্গি, উগ্র-মৌলবাদী সংগঠন বাংলাদেশে রয়েছে, তার সবগুলোর পিছনেই জামায়াতের মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ সব নেতাই দণ্ডিত হয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করেছে। অনেকেই ভেবেছিল জামায়াত নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে।
গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসেন সাইদী, কাদের মোল্লা, মীর কাসেমদের মত শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হবার পর জামায়াতের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের সবাই সাজা পাওয়ার পরও দেখা গেছে, জামায়াত এখনও তৎপর, সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত।
শুধু জামায়াত যে নিজের সংগঠন গোছাচ্ছে তাই নয়, জামায়াত একইসাথে হেফাজতে ইসলাম, খেলাফতে মজলিস বা অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনগুলোকেও পৃষ্ঠপোষকতা করছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। জামায়াতের অনেক নেতাই গোপনে এই সংগঠনগুলোর মধ্যে কাজ করছে। যদিও বাইরে থেকে বলা হয় যে, মতাদর্শগতভাবে এসব সংগঠনের সাথে জামায়াতের বিরোধ রয়েছে।
কিন্তু জামায়াত সব সময় বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীর একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকুক, এই লক্ষ্যে কাজ করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো আছে- জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ, আল্লাহর দল- ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠনগুলোর পেছনেও জামায়াতের মদদ রয়েছে।
এমনকি আল-কায়দার মত সংগঠনেও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন অনুসন্ধান এবং গবেষণায় দেখা গেছে। ২০১৩ সালের পর থেকে তাদের দলীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। মাঝে মাঝে তারা ভোরে মানুষ ঘর থেকে বেরোনোর আগে ঝটিকা মিছিল করে কিছু ছবি তুলে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা যেত।
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতকে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে নামতে দেখা গেছে। সেসব মিছিলে জামায়াত শিবিরের অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসীদেরও দেখা গেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে আলোচনা চলছে। নির্বাচনের পূর্বে তারা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে সতর্ক অবস্থানে।
তাই বোদ্ধা মহলের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত জামায়াতের রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা না হবে, সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা না হচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক শক্তির ভিত ভেঙে দেওয়া না হবে, তাদের নেতা-কর্মীদের মামলাগুলো যথাযথভাবে তদারকির মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত না করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির শেকড় উৎপাটন করা যাবে না।
একাধিক মামলায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। জনগণের মধ্যে থেকেও জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। কিন্তু নিবন্ধন বাতিল হলেও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ হয়নি।
কেন জামায়াত নিষিদ্ধ হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে একটি মামলা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলা বিচারাধীন থাকার কারণে সরকার জামায়াতের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
আর তাই অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য দ্রুত আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। দ্রুততর সময়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করার মধ্য দিয়ে জামায়াতের রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করা উচিত।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, আইনগতভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ করলেই জামায়াত নিঃশেষ হয়ে যাবে না। তাদের নেতা-কর্মীরা তো থাকছে, বরং তখন তারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে প্রবেশ করে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
পাকিস্থানপন্থী সংগঠন জামায়াতের রাজনীতি এবং আদর্শ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সর্বোপরি অস্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এ নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ করা হোক, না হোক সেটা বড় কথা নয়।
আসল বিষয় হলো, ৭২-এর সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে মূলভিত্তি তৈরি করেছিলেন, কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়- সেই আলোকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা পরিচালিত হওয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।