বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সন্ধানে বিশ্বজুড়ে পরিচালিত শ্বাসরুদ্ধকর সেই স্পেশাল মিশন

0

সময় এখন:

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ সুগম করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর খুনিরা কে কোথায়, শুরু হয় তত্ত্ব-তালাশ। গঠন করা হয় একটি টাস্কফোর্স।

এই টাস্কফোর্সের সব খোঁজ-খবরের মূল সমন্বয়ক ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব অ্যাম্বাসেডর ওয়ালিউর রহমান। তার দুই হাত হিসেবে কাজ করেছেন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা এনএসআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক মশিউর রহমান ও পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল হান্নান। আব্দুল হান্নান ছিলেন টাস্কফোর্সের প্রধান ইনভেস্টিগেটর।

কে কেথায় আছে, সেই খোঁজ পেতে একটি বড় সময় গেছে টাস্কফোর্সের। সেটা ছিল প্রায় ২ বছরের একটা অভিযাত্রা। শুরুতে হাতে কোনো তথ্যই ছিল না। একেবারে শূন্য থেকে এই দলের সদস্যরা কয়েকটি মহাদেশ ঘুরে খুঁজে বের করেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অবস্থান।

কেবল তা-ই নয়, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে তারা ঘুরেছেন আশ্রয় দেয়া দেশগুলোতে। সেখানকার শাসকদের সঙ্গে করেছেন দেনদরবার। এসব করতে করতে জীবনের ঝুঁকির মুখেও পড়েছেন কোথাও কোথাও। আততায়ীদের হাতে পড়েছেন। আবার কখনও পড়েছেন মরুঝড়ে। কখনও বিব্রত হয়েছেন অনৈতিক প্রস্তাবে। কখনওবা জীবন বাঁচাতে তারা পালিয়ে বেড়িয়েছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে।

মশিউর রহমান ও আব্দুল হান্নান আজ বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন ওই দলের একমাত্র সদস্য প্রধান সমন্বয়ক সাবেক সচিব অ্যাম্বাসেডর ওয়ালিউর রহমান। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন।

ওয়ালিউর রহমানের বয়ান:

আমি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে কাজ করি। আমার সামনে তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুটো অপশন দিলেন। এক হলো ‘ফরেন সেক্রেটারি’ হওয়া, অন্যটি হলো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুঁজে দেশে ফিরিয়ে আনার কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব পালন করা। আমি শেষটাই বেছে নিলাম। এবং প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, এই সুযোগ তো আমি আর পাব না। আমি এটাই নিতে চাই।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে দুটো কথা বললাম। এক হলো: আমি সব জায়গায় একা একা যেতে পারব না। আমি একা যাবও না। এটা ঠিকও হবে না। আপনি আমাকে একজন লোক দেন। যে আপনার বিশ্বস্ত। আর দ্বিতীয়টা হলো: এই যাত্রায় আপনি আমাকে ডেইলি অ্যালাউন্স বা ডিএ দেবেন না। কারণ সচিব হিসেবে তখন আমার ডিএ অনেক টাকা। বঙ্গবন্ধুর খুনি খোঁজার জন্য আমি কোনো ভাতা নিতে পারব না।

তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে সে সময়ের এনএসআই’র মহাপরিচালক মশিউর রহমানকে দিলেন সঙ্গী হিসেবে। তিনি খুবই দক্ষ ও হাই লেভেলের যোগাযোগসম্পন্ন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। মানুষ হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ সজ্জন। এসব কাজে সজ্জন ব্যক্তি সঙ্গী হলে সুবিধা হয়।

আমাদের সব টাকা এলো প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে। অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে মশিউর রহমান ছোট একটা অ্যামাউন্ট নিলেন তার তহবিল থেকে। আমাদের টিকেট আছে। তা দিয়ে সারা দুনিয়া আমরা বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করেছি, ভালো খেয়েছি, মোটামুটি ভালো হোটেলেও থেকেছি।

আমাদের অবস্থা হলো, আমরা দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকেছি। আমাদের হাতে তো কিছু নেই। আমরা জানি না, আমরা যাদের খুঁজছি, তারা কোথায় আছে। তাই প্রথমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি বই বের করলাম, যেখানে হত্যাকাণ্ডের ডিটেইলস থাকল সচিত্র। এরপর সচিত্র খুনিদের বর্ণনা থাকল।

এ ছাড়া ওয়ান্টেড নামে খুনিদের নিয়ে একটি পোস্টার বের করলাম। এরপর সেই বই ও পোস্টার সারা বিশ্বের মিশন, হাইকমিশন, দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো হলো। সবার কাছে আহবান জানানো হলো এই ঘৃণ্যতম খুনিদের সম্পর্কে তথ্য দিতে। তাদের ফিরিয়ে দিতে।

মিশরে ধূলিঝড়ের কবলে:

আমাদের প্রথম টার্গেট লিবিয়ার বেনগাজি। সেখানে আমাদের কর্নেল গাদ্দাফির সঙ্গে বৈঠক ঠিক করা হলো। দিন-তারিখ ঠিক করা হলো।

আমাদের এই লিবিয়া অভিযানে সহায়তা করেছিলেন গাদ্দাফির হাউজ স্পিকার অব পার্লামেন্ট আব্দুর রহমান আল শারগাম। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। আমি যখন রোমে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর, উনি তখন লিবিয়ার অ্যাম্বাসেডর। তিনি ভেরি এডুকেটেড ম্যান। একজন লেখক ও পণ্ডিত ব্যক্তি। আমি ঢাকা থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।

তিনি আমাকে বললেন, তোমরা প্লেনে এসো না। এতে সবাই তোমাদের আসার খবর জেনে যাবে। এবং তোমাদের নামও জেনে যাবে।

সে ক্ষেত্রে সেখানে যেতে দুটো বিকল্প উপায়ের একটি নিতে হবে। হয় আমাদের মিশর হয়ে গাড়িতে করে যেতে হবে। না হয় কায়রো থেকে মাল্টা হয়ে স্টিমারে করে যেতে হবে। আল শারগাম আমাদের গাড়ি ও স্টিমারের রুট ঠিক করে দেন।

আমরা কায়রো থেকে ওনাকে ফোন দিলাম। উনি গাদ্দাফির সঙ্গে আমাদের মিটিংয়ের ডেট ঠিক করলেন। কথা হলো, আমরা যাব, উনি সবাইকে কল করবেন এবং খুনিদের আমাদের হাতে তুলে দেবেন। তখন খুনি ডালিমসহ সবাই বেনগাজিতে বড় একটি ঘাঁটি তৈরি করেছে।

আমরা প্রথমে কায়রো থেকে গাড়িতে করে রওনা হলাম। আমাদের বলা হয়েছিল, শীতের সময় ওয়েদার ভালো থাকে। সমস্যা হবে না। কিন্তু মরুভূমিতে ভয়ংকর মরুঝড় বা স্যান্ড স্টর্মের কারণে আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। বলতে গেলে জীবন নিয়ে কায়রো ফিরতে সমর্থ হলাম। এরপর শারগামকে ফোন করে বললাম, আমরা মাল্টা যাচ্ছি।

অপারেশন মাল্টা:

আমরা কায়রো থেকে মাল্টা পৌঁছলাম। ইউরোপের ছোট দেশ মাল্টা। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র। অত্যন্ত ধনীদের কারবার সেখানে। আমরা সেখানে গিয়ে শারগামের পরামর্শে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলাম।

মাল্টা একটা অদ্ভুত জায়গা। সারা পৃথিবীর যত স্পাই এজেন্সি আছে, তাদের সবাই এখানে আছে। মাল্টা হলো সেন্টার ফর অল দ্য স্পাইজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। আমরা খুবই নিম্নমানের একটা হোটেলে ছিলাম। যেখানে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা ছিল না। খাওয়া-দাওয়া তো নাই-ই। আমরা নাশতা না করেই কাটাতাম।

পাশাপাশি দুটো রুম নিয়েছি। ৩ দিনের মতো ছিলাম সেই হোটেলে। সেখানে তখন আমাদের কোনো হাইকমিশন ছিল না। একজন ভারতীয় কনসাল জেনারেল ছিলেন। আমরা তার সঙ্গে দেখা করলাম এবং আমাদের আসার কারণ বললাম। তখন তিনিও জানলেন আমাদের ভেঞ্চারটা।

তিনিও একটু ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, অ্যাম্বাসেডর, বি কেয়ারফুল। মাল্টাতে আপনাদের এক্সট্রিম কেয়ারফুল থাকতে হবে। কারণ আপনারা এখানে এসেছেন, কেন এসেছেন, সবাই তা জানে। দিস ইজ মাল্টা। এখানে গোপন বলে কিছু নেই। এখানে যা আন্ডারগ্রাউন্ড, তাই ওভারগ্রাউন্ড।

আমি মশিউর রহমানের মুখের দিকে আর উনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। কী করা যাবে, বুঝতে পারছিলাম না।

আমরা আমাদের হোটেলের নাম কাউকে বলিনি। আমরা কেবল শারগামের পরামর্শ ও রেফারেন্সে পুলিশ কমিশনারকে আমাদের মাল্টা আসার রিপোর্ট করেছিলাম।

আমাদের স্টিমার ঠিক হলো। টিকেট কাটা হলো। আমরা বিলাসবহুল জাহাজে লিবিয়া যাব। ত্রিপোলিতে। আমাদের গাদ্দাফির সঙ্গে মিটিং শিডিউল করা। কথা ছিল আমরা ওখানে গিয়ে পৌঁছাব। আব্দুল রহমান শারগাম লোকজন নিয়ে আমাদের রিসিভ করবেন। আমাদেরকে তার নেতা গাদ্দাফির কাছে নিয়ে যাবেন। গাদ্দাফি তাদের (খুনিদের) ডাকবেন এবং আমাদের হাতে তুলে দেবেন, যতজন ওখানে আছে। ডালিম-টালিম সবাই তখন লিবিয়ায় থাকত।

আমরা সুন্দর একটা স্টিমারে করে যাব। খুবই সুন্দর কাজ করা। মাল্টা ধনী দেশ। লিবিয়াও তখন ধনী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া আরামদায়ক জাহাজ। যাত্রার আগেরদিন রাত আড়াইটায় হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। আমি দরজা খুললাম। আমি রাতপোশাক পরে আছি। দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং পুলিশ কমিশনার। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এত রাতে! আপনি এখানে কেন?

উনি বললেন, প্লিজ ডোন্ট আস্ক মি এনি কোয়েশ্চেন মি. অ্যাম্বাসেডর। প্লিজ কাম কুইকলি। আপনাদের খুন করার জন্য কেউ এখানে ভাড়াটে খুনি পাঠিয়েছে। দ্রুত আমার সঙ্গে বের হয়ে আসুন। সময় ছিল না। আমি দ্রুত জুতা-কাপড় ব্যাগে ঢুকালাম। স্যান্ডেল পরেই বের হয়ে গেলাম। মশিউর ভাইকে জাগালাম। তিনি বললেন, শেভ হতে পারলাম না। আমি বললাম, রাখেন আপনার শেভ-টেভ। আগে জীবন বাঁচান।

আমরা গেলাম পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। সেখানে আমরা আগে গিয়েছি, যেদিন এসেছিলাম। হেডকোয়ার্টারের পেছনে সুন্দর একটি রেসিডেন্স আছে। দারুণ কিছু স্যুট। বিদেশি অতিথিদের জন্য। পুলিশ কমিশনার তার একটি আমাদের থাকার জন্য দিলেন। বললেন, এখানে থেকে রাত কাটাও। এখান থেকেই কাল তোমাদের ফিরে যেতে হবে ইতালির মিলান। নট টু রোম।

আমি বললাম, কমিশনার, মিলানের চেয়ে রোম আমার জন্য ভালো। সেখানে আমি অ্যাম্বাসেডর ছিলাম। আমি সেখানের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবাইকে চিনি। তারাও আমাকে চেনেন। আমি সেখানকার রাস্তাঘাট সব চিনি।

তিনি বললেন, তুমি ওখানকার সবাইকে চেনো বলেই ওখানে যাবে না। পরের দিন উনি আমাকে বিমানে তুলে দিলেন। আমাদের যে টিকেট ছিল, তা বাদ। নতুন টিকেট করলেন, নতুন এয়ারলাইন্সে। আমরা মিলানে পৌঁছলাম।

আমি কল করলাম অ্যাম্বাসেডর শারগামকে। তিনি বললেন, আমি সব জানি। আমি তোমাদের সব খবর জানি। আমি তোমাদের ফোন দিচ্ছি। কিন্তু তোমরা ধরছ না। (তখন তো মোবাইল ফোন নেই। উনি কল করছিলেন হোটেলের ফোনে। আমরা তো তখন দৌড়ের ওপর।) তোমরা আসতে পারছ না, সেটা আমি জানি। মাল্টায় কী হচ্ছে, ত্রিপোলি তা জানে। রশীদ খুনি পাঠিয়েছে, তা আমি লিডারকে (গাদ্দাফি) জানিয়েছি।

আমাদের অভিযান আল্টিমেটলি ব্যর্থ হলো। আমরা মিলান থেকে লন্ডন গেলাম। সেখানে আমাদের অসমাপ্ত কিছু কাজ ছিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে আমাদের কাজ ছিল। আমরা গেলাম যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আমরা সেখান থেকে এমআই-ফাইভ, এমআই-সিক্সকে সঙ্গে নিয়ে পৃথক একটি গাড়িতে গেলাম ৩০-৪০ মাইল দূরে নর্থ ইস্ট কেন্ট বলে একটি জায়গায়। সেখানে পাশাপাশি দুটো বাড়ি ছিল। এর একটি খুনিদের ঘাঁটি ছিল।

তাদের ইউরোপের দুটি ঘাঁটির একটি ছিল মিলান, অপরটি এই লন্ডনে। লন্ডনের এই বাড়িতে তারা বছরে দুই-তিনটি মিটিং করত। সবাই এক হতো। মিলানেরটা আগেই আমি বন্ধ করেছিলাম ইতালির সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রোদির মাধ্যমে। এবার লন্ডনেরটা বন্ধ হলো। ওদের মবিলিটি বন্ধ হয়ে গেল।

আমরা মশিউর রহমানের মাধ্যমে এই বাড়ির খবর পেয়েছিলাম। তার অসম্ভব যোগাযোগ ছিল দুনিয়াজুড়ে। তিনি এই বাড়ি খুঁজে বের করলেন।

তিনতলা বাড়ি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকেরা গিয়ে প্রথমে দরজা ধাক্কাল। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করল। সব ঠিকঠাক আছে। বিছানা-বালিশ। কেউ তখন না থাকলেও বোঝা গেল এখানে নিয়মিত লোকজন আসে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড দুটো কাঠ নিয়ে এসে বাড়িটি সিলগালা করল। তারা লিখে দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এই বাড়ি বাজেয়াপ্ত করছে। কেউ এখানে প্রবেশ করলে তা বিচারযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।

পাশার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার চাইলেন মুগাবে:

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন আব্দুল আজিজ পাশা। তিনি তখন জিম্বাবুয়েতে জাঁদরেল ব্যবসায়ী। মুগাবে সরকারের খুব ঘনিষ্ঠজন তিনি। তাকে আনতে জিম্বাবুয়েতে গিয়েছিলাম আমরা। অভিজ্ঞতাটা মোটেও সুখকর ছিল না।

জিম্বাবুয়েতে তখন একটি মিশন ছিল। এখন নেই। তুলে আনা হয়েছে। তখন মিশনের দায়িত্বে ছিলেন বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। আমরা একটি মিটিং ঠিক করি প্রেসিডেন্ট রবার্ট গ্যাব্রিয়াল মুগাবের সঙ্গে।

প্রথমে তার সোশ্যাল সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, অ্যাম্বাসেডর, কোনো ব্যাপারই না। কখন দেখা করতে চান? আমি বললাম, যখন সময় দেবেন। তিনি বললেন, যখন খুশি আসেন। তবে দেখুন, আমাদের তো একটা এনজিও আছে। সেখানে কিছু ডোনেশন দিন।

আমি বললাম, কত বলুন। আমরা তো টাকা নিয়ে আসি নাই। একেবারে মিনিমাম কত বলুন। তখন তিনি ৫ হাজার ডলার দাবি করে বসলেন। আমি বললাম, এত টাকা তো আমাদের কাছে নাই। আমরা টাকা বহন করি না। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে, যা দেবেন, দিন। আমি বললাম, ১ হাজার ডলার দিতে পারব বড়জোর।

তখন তিনি বললেন, এত কমে হবে না। তখন আমাদের হাইকমিশনারের কাছ থেকে নিয়ে তাকে ২ হাজার ডলার দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে মেইল করলাম। প্রধানমন্ত্রীও দেরি না করেই আমাদের তা পাঠিয়ে দিলেন।

ভদ্রমহিলা এরপর রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আমরা সহজেই সরাসরি প্রেসিডেন্ট মুগাবের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনি হাত মেলালেন। কফি অফার করলেন। এরপর বললেন, দেখুন, আপনারা কেন এসেছেন আমি জানি। ও (আজিজ পাশা) আমাদের কাছে আছে। আমরা ওকে দেখে রেখেছি। তাকে তো আমরা ছাড়তে পারব না।

আমি বললাম, দেখুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপনার কলিগ ছিলেন। আপনি তাকে চিনতেন। কমনওয়েলথে তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার খুনিকে আপনারা সাপোর্ট করছেন। আশ্রয় দিচ্ছেন। এটা কি ঠিক? আপনি তাকে বিচারের জন্য ছাড়বেন না?

তখন মুগাবে বললেন, দেখুন, আমার ওয়াইফ মারা গেছেন। তার নামে একটি ওয়েলফেয়ার ফান্ড আছে। আপনারা সেই ফান্ডে কিছু টাকা দিন। আমি বললাম, আমরা টাকা নিয়ে আসিনি। আপনার সঙ্গে দেখা করতেই আমাকে টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বললেন, এটা খুবই ছোট বিষয়। আমার মেয়ে আছে। সে কিছু কাজটাজ করে। আমি বললাম, মিনিমাম কত লাগবে বলুন! তিনি বললেন, ১০ মিলিয়ন ডলার দিন, আমি তাকে (আজিজ পাশা) সেন্ড করব।

হারারেতে পাশাকে তারা সুন্দর বাড়ি করে দিয়েছিল। গাদ্দাফির কাছ থেকে উপহারের টাকায় ১০টা বাস কিনে দিয়েছিল। তিনি সেইগুলো চালাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন বিনিয়োগকারী। জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে তিনি ধনী লোক।

আমি মুগাবেকে বললাম, দেখুন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আপনাকে চিঠি লিখেছেন। আপনি যখন পশ্চিমাবিরোধী বিদ্রোহ করেছিলেন, আমরা তখন আপনাকে সমর্থন করেছিলাম। তখন তিনি বললেন, দেখুন ৫ মিলিয়নের নিচে আমি তাকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব না।

আমরা বের হয়ে আসি এবং প্রধানমন্ত্রীকে জানাই, আমরা টাকা দিতে রাজি হইনি। তিনি বলেন, ঠিক আছে। এর ২ বছরের মধ্যে আজিজ পাশা মারা যায়।

কেনিয়াতেও মেলে হতাশা:

কেনিয়ার অভিজ্ঞতা জিম্বাবুয়ের চেয়েও খারাপ। আমরা নাইরোবিতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্টেট মিনিস্টার, কতজনের সঙ্গে যে বসেছি! কিন্তু তারা শুরু থেকেই খুনিদের ফিরিয়ে দিতে নারাজ ছিল। খুনিদের সঙ্গে তাদের প্রশাসনের বংশ পরম্পরায় ব্যবসা ছিল। নাইরোবির সবাই ছিল করাপ্ট ম্যান। আমরা দেয়ালে মাথা ঠুকে কিছু করতে পারছিলাম না।

জিম্বাবুয়েতেও আমরা শিওর ছিলাম, মুগাবেকে টাকা দিতে রাজি হলে আজিজ পাশাকে ফেরত পেতাম। কিন্তু কেনিয়াতে কেউই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হলো না। ডালিম সেখানে চতুরতার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি সেখানকার সিনেটর। তিনি কেনিয়ার পলিটিশিয়ান সিনেটর। মাল্টি-মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।