মুক্তমঞ্চ:
২০১৩ সালের কথা। চ্যানেল আই-এর পর্দায় ইত্তেফাকের দেশবিখ্যাত ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদ-এর অস্বাভাবিক মৃত্যুর স্ক্রল দেখে মনটা খুবই খারাপ হলো। এই ভদ্রলোককে আমি পছন্দ করতাম না। কিন্তু তারপরেও তার এইরকম মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় আফতাব আহমেদের মৃতদেহ তাঁর রামপুরার বাসভবনের ফ্লোরে পড়েছিলো।
আলোকচিত্রি আফতাব আহমেদকে আমি কেন পছন্দ করতাম না সেটা বলি। ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন শেখ মুজিবকে বিপদে ফেলতে শক্তিশালী একটি চক্র সেই দুর্ভিক্ষকে সৃষ্টি করেছিলো। মানবসৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছোবল সবচে বেশি দৃশ্যমান ছিলো উত্তরবঙ্গে।
সেই দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে থাকা সরকার। (সচেতন নাগরিকমাত্রই জানেন প্রকৃতি এবং লোভী রাজনীতিবিদদের অমানবিক লুটেরা রাজনীতির কারণে প্রতিবছর ‘বার্ষিক মঙ্গার মৃত্যু উৎসব’ হতো উত্তরবঙ্গে। সেই মঙ্গা এখন বিলুপ্ত হয়েছে।)
কিন্তু চুয়াত্তরের প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। শেখ মুজিবের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য শত্রুরা তাঁকে রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যর্থ প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিলো। সেই ষড়যন্ত্রে শামিল ছিলো তৎকালীন হাইয়েস্ট সার্কুলেটেড পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ও। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’র মতো ইত্তেফাকও দুর্ভিক্ষের সন্ধানে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে রিপোর্টার শফিকুল কবির এবং ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদকে পাঠিয়েছিলো রংপুরের কুড়িগ্রামে।
আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত ছিলো। বিশেষ একটি নৌকায় বিশেষ একজনের পথ প্রদর্শন বা গাইডেন্সে বিশেষ একটি অঞ্চলে গিয়ে একটি হতদরিদ্র পরিবারের অনাহারী মেয়ে বাসন্তীকে নগদ ৫০ টাকার বিনিময়ে রাজি করানো হয় একটি ফটোসেশনে। দরিদ্র বাসন্তী চকচকে ৫০ টাকার নোটটি পাবে যদি একটি ছেঁড়া জাল সে পরিধান করে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে।
সেই সময়, ১৯৭৪ সালে, হতদরিদ্র বাসন্তীর কাছে ৫০টি টাকা রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার। বাসন্তী রাজি হয়েছিলো। শফিকুল ৫০ টাকার নোটটি বাসন্তীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গাইড-এর দূতিয়ালীতে সংগৃহিত ছেঁড়া জালটি গায়ে জড়িয়ে কলার থোড় সংগ্রহ করছে অনাহারী বাসন্তী। তার পাশে দুর্গতি নামের ছিন্ন পোশাকের আরেকটি মেয়ে।
আফতাবের ক্যামেরা সেই পূর্বপরিকল্পিত সাজানো ছবিটি ধারণ করেছিলো। রংপুর মিশন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন ইত্তেফাকের রিপোর্টার শফিকুল আর ফটোগ্রাফার আফতাব। আফতাবের তোলা ভুয়া সেই ছবিগুলোর একটি ছাপা হয়েছিলো ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়।
আমেরিকার বিশ্বস্ত অনুচর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আর ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনরা সেটা ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় লিড ফটো হিশেবে ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী শেখ মুজিবকে চরম ব্যর্থ একজন শাসক হিশেবে প্রমাণ করে মুজিবকে উৎখাত কিংবা হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো ছবিটি। এর এক বছরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিলো নৃশংসভাবে, সপরিবারে।
মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট নির্মাণের অন্যতম কুশীলব হিশেবে শফিকুল আর আফতাবকে আমি ঘৃণা করতাম। আমার সেই ঘৃণার প্রকাশ্য প্রতিফলন ঘটেছিলো একবার ১৯৯৬ সালের মার্চে। ধানমণ্ডি ৬ নম্বরে আওয়ামী ফাউন্ডেশনে তখন মাঝে মধ্যেই জরুরি সভায় মিলিত হতাম আমরা, সাংস্কৃতিক অঙ্গণের কতিপয় যোদ্ধা।
আমাদের সেই সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল, ভাষাসৈনিক গাজিউল হক, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত থাকতেন নিয়মিত। আমাদের সেই সভায় আওয়ামী লীগের মুরুব্বী প্রতিনিধি হিশেবে অধ্যাপক কামারুজ্জামান থাকতেন। জননেত্রী শেখ হাসিনাও এসেছিলেন একদিন। আমাদের সেই সভায় পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ বাড়ছিলো।
এক বিকেলে সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী এলেন আফতাব আহমেদকে বগলদাবা করে। এসে যথারীতি বসে পড়লেন আমাদের গোল টেবিল বৈঠকের দুটো চেয়ারে, আমার ঠিক বিপরীত দিকে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। অনুচ্চ কণ্ঠে বললাম—আমাদের সভায় গোলাম আযমের নাগরিকত্বের দাবিতে বিবৃতি দেয়া সাংবাদিক কেন? বাসন্তীর জাল পরা জাল ছবির সেই ফটোগ্রাফার কেন? কে ওদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন?
আমাকে থামানোর চেষ্টা করলেন কামারুজ্জামান। আমি থামছি না। এরপর আমাকে থামাতে চাইলেন গাজিউল হক। আমি থামছি না। বরং আমার কণ্ঠস্বর আরো উচ্চকিত হয়ে উঠছে। এতক্ষণ আমার প্রতিবাদ শুনতে পাচ্ছিলেন আমার আশপাশের চার-পাঁচজন। আমি উচ্চস্বরে একই বাক্য রিপিট করলে সবাই সেটা শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন ওরা দুজনও।
কামারুজ্জামান ভাই এবং গাজি ভাইয়ের ইশারায় মুকুল ভাই (এম আর আখতার মুকুল) আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের একটা ছোট্ট কক্ষে যেখানে কম্পিউটারে কাজ করেন অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান (পরবর্তীতে পূর্তপ্রতিমন্ত্রী) এবং নকীবরা।
সেই রুমে দরোজা বন্ধ করে মুকুল ভাই আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন— তুমি তো মিয়া বোমা ফাটাইয়া দিছো আইজকা। আফতাবরে আনছে ক্যাডা দেহো নাই? অরে আনছে ইকবাল সোবহান। সাম্বাদিকগো ন্যাতা। ইকবাল সোবহানরে বাইর করন যাইবো না আর আফতাবরে বাইর কইরা দিলে তো সাম্বাদিক ন্যাতারে অপমান করা অয়। তুমি তো হালায় বুঝো ছবই। ক্যালা খামাখা দিগদারি করতাছো!
যুক্তিতে আমি খুব সহজেই ঘায়েল করে ফেললাম মুকুল ভাইকে। মুকুল ভাই আমার লজিকগুলো মেনে নিয়েই বললেন- যেইডা বুঝানের হেইডা তো মিয়া তুমি বুঝাইয়াই দিছো। এলায় চুপ থাকো। মেসেজ যেইটা দেওনের তুমি অইটা অগো দুইজনরেই দিয়া দিছো। আন্দোলনের স্বার্থে তুমি এলায় খামোশ থাকবা। এইডা গাজি ভাই আর কামারুজ্জামানের পক্ষ থিকা তোমার কাছে আমার রিকোয়েস্ট। হ্যারা কেউ তোমারে সাইজ করতে পারবো না বইলাই আমারে দায়িত্ব দিছে তোমারে ঠান্ডা করনের। আন্দোলনের স্বার্থে তুমি চাইপা যাও, ঠিকাছে? বলতে বলতে মুকুল ভাই আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে সঙ্গে করে মুকুল ভাই ফিরে এলেন সভাকক্ষে। বিব্রতকর একটা পরিস্থিতির ভেতর সভা চললো।
এটা ছিলো আফতাব আহমদের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। এর আগে ১৯৯১ সালে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার গ্রিনরোড কার্যালয়ে এক দুপুরে এসেছিলেন তিনি। আমি তখন পত্রিকাটার ফিচার এডিটর। সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার টেবিলে এসেছিলেন তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে। আমি তাকে চা অফার করেছিলাম ঠিকই কিন্তু তার প্রতি আমার ক্ষোভের কথাটাও জানিয়েছিলাম অকপটে।
বলেছিলাম— জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট বা পটভূমি নির্মাণে আপনিও তো একজন কুশীলব ছিলেন! চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেশ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ছবিটা সাজানো ছিলো সত্যি কিন্তু ওটার পেছনে এতোবড় একটা ষড়যন্ত্র আছে তা তিনি জানতেন না।
তার জবাবটিকে নাকচ করে দিয়ে আমি বলেছিলাম— পলিটিক্যালি মোটিভেটেড বলেই ইত্তেফাক আপনাদের দুজনকে কুখ্যাত সেই অ্যাসাইনমেন্টের জন্যে নির্বাচন করেছিলো। যে কোনো কারণেই হোক— আপনারা শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের প্রবল বিরোধী ছিলেন। তাছাড়া আপনি রংপুরের সন্তান। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা এবং পথঘাট আপনার চেনাজানা।
জবাবে আফতাব আহমেদ বলেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু কিংবা আওয়ামী লীগের বিরোধী কেউ নন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বহু ছবি তুলেছেন। ৬৯-৭০-৭১ সালের বহু ঐতিহাসিক ছবি তার তোলা। সেসব ছবিতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আছেন।
এ বিষয়ে তার কোনো অনুশোচনা আছে কী-না জিজ্ঞেস করলে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন আমরা কথা বলেছিলাম দীর্ঘক্ষণ ধরে। এক পর্যায়ে প্রস্থানের আগে ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে ধরেছিলেন। শাদাকালো সেই ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল আফতাব আহমেদের হাতে ইঞ্চিতিনেক লম্বা একটা খুদে পিস্তল। সেটা তিনি এমন ভঙ্গিতে ধরে আছেন যে মনে হবে এক্ষুণি কাউকে গুলি করেছেন কিংবা করবেন।
ছবিটা হাতে নিয়ে আমি হেসে ফেললে স্মিতহাস্যে উদ্ভাসিত হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। আমি ছোটদের জন্যে মজার ছড়া লিখি বলেই আমাকে মজার একটা ছবি উপহার দিয়ে তিনি আসলে আমাকে খুশি করতে চেয়েছিলেন। আফতাব ভাইয়ের সেই ছবিটা ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।
বাংলাবাজার পত্রিকা অফিসে আফতাব ভাই আমাকে সত্য বলেননি। বাস্তবে তিনি বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরের বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। আমরা স্মরণে আনতে পারি— ১৯৯৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া ফটোসাংবাদিকদের কোনো একটি অনুষ্ঠানে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের বিশেষ করে বাসন্তীর মর্মষ্পর্শী ছবিটি তোলার কারণে আলোকচিত্রি আফতাব আহমেদকে পুরস্কার দেবার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সেই ঘোষণার পর ইত্তেফাকে বিবৃতি দিয়ে আফতাব আহমেদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন খালেদা জিয়ার প্রতি। এবং আমরা আরো স্মরণে আনতে পারি যে— ২০০৬ সালে একুশে পদক পেয়েছিলেন তিনি। আর সেই পুরস্কারটি দিয়েছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
২০০৬ সালে আরেকটি ঘটনায় আফতাব আহমেদের রাজনৈতিক চরিত্রটি আরো ষ্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সেই বছর ইসলামিক ছাত্র শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ পদক প্রদান করা হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর হাত থেকে পদকটি গ্রহণ করেছিলেন হাস্যোজ্জ্বল আফতাব আহমেদ।
২০১৩ সালে চ্যানেল আইয়ের খবরে নিজের ঘরের মেঝেতে লাশ হয়ে পড়ে থাকা আফতাব আহমেদকে দেখে এক ঝটকায় বহু স্মৃতি এসে ভিড় করলো।
লেখক: লুৎফর রহমান রিটন
পরিচিতি: সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক।