বিশেষ প্রতিবেদন:
দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির চাকা সচল করেছে। আগামী ২৮শে মার্চ বাম জোটগুলো হরতাল ডেকেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এই হরতাল ডাকা হয়েছে। এই হরতালের প্রেক্ষাপটেই বাম জাগরণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি প্রধান বাম রাজনৈতিক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যে, এই নতুন নেতৃত্ব কি বাংলাদেশে বাম জাগরণের সুযোগ তৈরি করতে পারবে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামদের একটি শক্ত অবস্থান ছিল বিভিন্ন সময়।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বৃহৎ রাজনৈতিক দল হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের ছায়ায় বাম রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় বিকশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাসী বাম দলগুলো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছিল এবং বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখিয়েছিল।
কিন্তু আস্তে আস্তে বাম রাজনীতিতে ভাটার টান দেখা যায়। একসময় বাম রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় বিলীন হয়ে যায়। সেই অবস্থা থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বাম দলগুলো একটি স্বাতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে। সেখান থেকে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠে।
যদিও বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাহসী পদক্ষেপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বাম রাজনীতির জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। মৌলবাদী ও উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়বে, সেখানে সেক্যুলার বাম শক্তির একটি উত্থান ঘটবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর আসলে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর কোন উত্থান হয়নি। বরং ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম, খেলাফতে মজলিস, খেলাফত আন্দোলনের মধ্য ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো এখন বামদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী বলে মনে করা হচ্ছে। আর বামদলগুলোর সাথে একই ইস্যুতে ধর্মান্ধরা সরকারবিরোধীতার নামে রাস্তায় জড়ো হয়।
বাম রাজনৈতিক দলগুলো আসলে কী করতে চায়, সে নিয়েই এক ধরনের দ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চয়তা কাজ করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে কী দিয়েছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখা গেছে দ্বিধান্বিত। তাদের প্রার্থী নির্বাচনও ছিল ‘কম্প্রোমাইজড’। অর্থাৎ এমন লোকজনকে তারা নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিল, যারা আদৌ বাম আদর্শের অনুসারী কি না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বরং সেসব প্রার্থীর অনেকের সাথে ধর্মান্ধদের সম্পৃক্ততার দাবিও করেছেন অনেকেই।
এ সময় বামদের কৌশলগত ভুল সবার চোখেই পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাম রাজনৈতিক দলগুলো যে এখন পৃথক অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছে এর ফসল ঘরে তুলছে উগ্র-মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশে বাম রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা। বিশেষ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবেই কাজ করেছে। সেখান থেকে যখন এখন বাম রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগবিরোধী হয়ে যাচ্ছে তখন বাম গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের মধ্যে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
বাম রাজনৈতিক দলগুলো যে পৃথক প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে চায়, সেটিও কতটা বাস্তবসম্মত এবং আদৌ তাদের সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বাংলাদেশের বাম নেতৃত্বে যে স্বর্ণযুগ ছিলো, সে স্বর্ণযুগের পর নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেনি।
মনি সিং, মোহাম্মদ ফরহাদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, খলিকুজ্জামান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের যে জাতীয় নেতৃত্বের ইমেজ, সেখান থেকে এখনকার বাম রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং দলীয় ইমেজের মধ্যে বন্দি হয়ে রয়েছে।
এই অবস্থা থেকে বামদের উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। তবে বিশ্ব বাস্তবতায় এখন বাংলাদেশে বাম জাগরণের সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।