সময় এখন:
দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজার নাম বাদ দিয়েছে সরকার।
সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত আমির হামজার নাম বাদ দিয়ে শুক্রবার ৯ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এর আগে ১৫ই মার্চ ২০২২ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ১০ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। নাগরিক মহলে অচেনা আমির হামজার নাম সেখানে দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য এবার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) ছাড়াও মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস এবং সিরাজুল হক মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন।
একই ক্যাটাগরিতে আব্দুল জলিল ও সিরাজ উদদীন আহমেদকে এ সম্মাননার জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
চিকিৎসাবিদ্যায় মনোনয়ন পেয়েছেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া এবং অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম।
স্থাপত্যে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে।
নতুন তালিকায় তাদের সবার নাম থাকলেও সাহিত্যে প্রয়াত আমির হামজার নামটি শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে। সাহিত্যে অন্য কারও নাম সেখানে দেওয়া হয়নি।
নতুন তালিকার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কোনো ব্যাখ্যা না দিলেও আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আমির হামজাকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি পর্যালোচনা করার কথা এর আগে বলেছিলেন ‘জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র আহ্বায়ক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
বৃহস্পতিবার তিনি বলেছিলেন, তারা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবেন। পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগও রয়েছে।
এর পরদিনই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করল।
আমির হামজার বিষয়ে খবর নিয়ে ‘বাঘের থাবা’, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ ও ‘একুশের পাঁচালি’ নামে তার তিনটি বইয়ের হদিস পাওয়া যায়। জন্মস্থান মাগুরায় তাকে ‘চারণ কবি’ হিসেবে চিনতেন অনেকে। কেননা তিনি গানের আসরে বসে গান লিখতেন, সুর করতেন।
নির্বাচনে আমির হামজা আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন বলে স্থানীয়দের কথায় উঠে আসে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১৯৭৮ সালে একটি খুনের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন আমির হামজা।
বিচারিক আদালতের রায়ে ওই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হলেও পরে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ সাধারণ ক্ষমা পান তিনি।
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নিভৃত গ্রাম বরিশাটের বাসিন্দা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি আমির হামজা জীবনজুড়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দেশপ্রেমকে ধারণ করেছিলেন।
১৯৩১ সালে জন্ম নেয়া দীর্ঘদেহী আমির হামজা মধ্য বয়সে সংসারের মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময় রাইফেলের পাশাপাশি ধরেছিলেন কলমও। মহানায়কের কণ্ঠ যেন ধ্বনিত হয়েছে তার লেখা কবিতায়।
দেশ স্বাধীন হলো যুদ্ধজয়ী বীরের দল যে যার ঘরে ফিরে গেল। কবিও ফিরলেন, তবে মনটা তার আটকে ছিল বঙ্গবন্ধুতেই।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তার লেখা কবিতা ও গানের শব্দ চয়নে যে গভীরতা, তা যেকোনো মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।
বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে তিনি লিখেছেন-
‘যে ক্ষতি তুমি করিতে পারো না পূরণ / কেন সেই মহাপ্রাণ করিলে হরণ / কারে নিয়ে বলো আজ কবিতা লিখি / একটি মুজিব এনে দাও তো দেখি…।’
অথবা, ‘এই প্রার্থনা বঙ্গজননী, আমার কথা নিও / যুগে যুগে তুমি শেখের মতো দু’একটা ছেলে দিও।’
কবি আমির হামজা ছিলেন দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত কবিয়াল বিজয় সরকারের শিষ্য। অনেক বাঘা বাঘা কবিয়ালের সঙ্গে পালা ও কবিগানের টক্করে আসর মাত করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে তার।
সমগ্র গ্রামবাংলা ছিল কবি আমির হামজার বিচরণক্ষেত্র। বাংলার সংস্কৃতির বাহক হিসেবে জারি ও কবিগানের মধ্যযুগীয় ধারাকে আধুনিকায়নে কবি আমির হামজার অবদান অনস্বীকার্য। মধ্যযুগীয় ধারায় কবিগানের মূল বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম, পীর-ফকির ও দেব-দেবীর পরস্পরবিরোধী মহিমা কীর্তন ও আদি রসাত্মক চিত্তবিনোদন।
আধুনিক যুগে এর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিবর্তনের এই ধারায় কবিয়াল আমির হামজা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন। তিনি জারি ও কবিগানে দেশপ্রেম, প্রকৃতি, মাটি ও মানুষকে অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেন।
কবির এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩টি। বাঘের থাবা, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি ও একুশের পাঁচালি। ৩টি গ্রন্থই ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে মুদ্রিত হয়েছে। তার অপর দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘কাব্যরাণী’ ও ‘ইকরা’ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
বরিশাট গ্রামের লোকজন ও কবির পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, আমির হামজা একই আসরেই গান লিখে, সুর করে তা পরিবেশনও করতে পারতেন। তার কবিজীবনের অপর বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি তাৎক্ষণিক দেশ ও জাতির হয়ে এমন গান ও কবিতা লিখতেন, যা মানুষ তার কাছে আশা করত।
অন্যদিকে, রণাঙ্গনের দুর্ধর্ষ গেরিলা আমির হামজা ছিলেন অসীম সাহসের অধিকারী। ১৯৮৩ সালে যখন রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নাম বলা যেত না, সে সময় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রশাসনের নির্দেশ উপেক্ষা করে তিনি জাতির পিতাকে নিয়ে স্বরচিত গান পরিবেশন করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি সুরকার শেখ সাদী খান কবি আমির হামজার ‘একটি মুজিব এনে দাও তো দেখি’ গানটির সুর করেছেন। বর্তমানে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী রফিকুল আলম। গানটি বাজারে আসার অপেক্ষায় আছে।
তিনি লিখেছেন এবং গেয়েছেন আপন মনে। কোনো প্রতিদান অথবা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা করেননি। যে কারণে তার অনেক সৃষ্টি সংরক্ষিত হয়নি। বর্তমানে কবির পরিবার তার কিছু সৃষ্টি পাঠকের জন্য প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিভৃতচারী কবিয়াল আমির হামজা অনেকটা নিভৃতেই ২০১৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আমির হামজার ছেলে আসাদুজ্জামান সরকারি কর্মকর্তা। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন তিনি। পিতাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ছেলের তৎপরতার কথাও আসে সংবাদ মাধ্যমে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী মোজাম্মেল বলেছিলেন, আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মতামত। আমি খতিয়ে দেখি সেগুলো সঠিক অভিযোগ কি না। যেমন- মার্ডার, এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত কি না? তার সাহিত্যকর্ম কী আছে, সেগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখব।
আমির হামজার আগে ২০২০ সালে সাহিত্যে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রইজ উদ্দিনের নাম ঘোষণা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল সাহিত্যিকদের মধ্যে।
সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন জনের সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি টেলিভিশন টক শোর আলোচনার বিষয়বস্তুও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সমালোচনার মুখে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে রইজকে বাদ দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তখন রইজ বলেছিলেন, কেন দিল, কেনই বা কেড়ে নিল!
স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের সাধারণত ২৫শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী।