সময় এখন ডেস্ক:
গ্রীষ্মের ঝড়-বাদল শুরু হওয়ার আগেই কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে, হাতে সময় একেবারেই কম। ধান তোলার এই মৌসুমে করোনা ভাইরাসের কারনে দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। এতে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সং’কট। আর তাই প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন, ছাত্ররা যেন কৃষকদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। করোনা মোকাবেলার পর যেন দেশে দু’র্ভিক্ষ না লাগে, যেন খাদ্যের সং’কট না হয়, সেজন্য কৃষকের ধান ন’ষ্ট হওয়ার আগেই ঘরে তুলে দিতে তিনি এমন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
আর এই আহ্বানে সবার আগে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়ের পরতে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে কৃষকদের সাথে মাঠে নেমে কাজ করছেন। কৃষিবিদরা এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে বলছেন, এটাও পর্যাপ্ত নয়। আরও অনেক মানুষ প্রয়োজন বৃষ্টি আসার আগেই দ্রুত ধান ঘরে তুলতে। তবে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছেন- কৃষকদের নিয়ে রাজনীতি করা দেশের অনেক রাজনৈতিক এবং ছাত্র সংগঠন রয়েছে, তাদেরকে কেন দেখা যাচ্ছে না এমন উদ্যোগে সামিল হতে?
সারাদেশে ছাত্রলীগের মহতী উদ্যোগের কিছু অংশ:
গাজীপুরে দরিদ্র কৃষকের ধান কাটলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা:
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে কৃষকের পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। গতকাল শনিবার উপজেলার সীমান্তবর্তী কাওরাইদ ইউনিয়নের গুনিয়া ফকির পাড়া গ্রামের কৃষক সারফুল মিয়ার ১ বিঘা জমির পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দেন তারা।
সারফুল কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে শ্রমিক না পাওয়ায় তিনি তার পাকা ধান কাটতে পারছিলেন না। খবর পেয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য তেলিহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া গ্রামের সুলতান মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের উদ্যোগে ছাত্রলীগের ১৩ জন নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে ওই কৃষকের ১ বিঘা জমির পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দেন। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে ধান কাটার কাজ।
সিরাজুল বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নির্দেশ দিয়েছে কৃষকদের পাশে থাকতে। ছাত্রলীগ যে কোনো মানবিক সং’কটে সাধারণ মানুষের পাশে থাকে। করোনা মোকাবেলায় মাঠে থেকে সর্বোচ্চ কাজ করছে ছাত্রলীগ। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাই শ্রমিক সং’কটের কারণে কৃষক সারফুল তার পাকা ধান কাটতে পারছে না। কাল বৈশাখীর মাস, যে কোনো সময়ে ঝড়-বৃষ্টি হলে ফসল ক্ষ’তিগ্রস্ত হওয়ার আশ’ঙ্কা থাকে। তাই আমরা ছাত্রলীগের ১৩ জন নেতাকর্মী কাস্তে-মাথাল (ধান কাটার সরঞ্জাম) নিয়ে হাজির হই।
কৃষক সারফুল ইসলাম জানান, প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, সুলতান ভাইসহ তার সহকর্মীরা বিনা পারিশ্রমিকে আমার জমির ধান কেটে ঘরে তুলে দেবে। জমির ধান কেটে বাড়িতে তুলে দেওয়ার পর আমার বিশ্বাস হয়েছে। তারা ধান কেটে দেয়ায় আমার অন্যরকম আনন্দ লাগছে।
এ সময় তার সাথে সহযোগিতা করেন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সদস্য- আলমগীর হোসেন মারুফ, শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক সজীব হাসান, ছাত্রলীগ নেতা ফাহাদ হোসেন বাদশা, সৈয়দ মিজানুর রহমান, মামুন মিয়া, শাকিল হাসান এবং তেলিহাটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক সজল হাসান রানা।
কক্সবাজারে দরিদ্র কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিল ছাত্রলীগ:
হাফেজ আহমেদ একজন অ’সহায় দরিদ্র কৃষক। পাকা ধান পড়ে আছে ফসলের মাঠে। করোনায় শ্রমিক ও অর্থ সং’কটে সেই পাকা ধান ঘরে তোলা নিয়ে ছিলেন চরম দু’শ্চিন্তায়। অবশেষে দরিদ্র এই কৃষকের দু’শ্চিন্তা দূর করে দিলেন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের উপ দপ্তর সম্পাদক ও কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি ছাত্রলীগের সভাপতি মইন উদ্দিনের নেতৃত্ব ৩০ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দেন।
গতকাল শনিবার (১৮ এপ্রিল) সারাদিন কেটে ২ কানি (৮০ শতক) পরিমাণের ফসল কেটে দেন তারা। কৃষক হাফেজ আহমদের বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের রাস্তারপাড়া এলাকায়।
কৃষক হাফেজ আহমেদ জানান, তিনি এবার ২ কানি জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছে। ক্ষেতের ফসলে পাক ধরেছে কিন্তু ধান কাটার মজুরের অভাব। এ অবস্থায় প্রতিবেশী ছাত্রলীগ নেতা অনিককে বলেছিলেন ক’ষ্টের কথা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখেন হঠাৎ কাস্তে হাতে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী উপস্থিত ধান কাটতে।
ছাত্রলীগ নেতা মইন উদ্দীন বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নির্দেশ দিয়েছে কৃষকদের পাশে থাকতে। ছাত্রলীগ যে কোনো মানবিক সং’কটে সাধারণ মানুষের পাশে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মাধ্যমে খবর পাই শ্রমিক সং’কটের কারণে হাফেজ আহমেদ তার পাকা ধান কাটতে পারছে না। বৈশাখ মাস, তাই যে কোনো সময়ে ঝড়-বৃষ্টি হলে ফসল ক্ষ’তিগ্রস্ত হওয়ার আশ’ঙ্কা থাকে। তাই আমরা ছাত্রলীগের ৩০ নেতাকর্মী কাস্তে-মাথাল নিয়ে হাজির হই। সারাদিন কাজ করে ২ কানি জমির ধান কেটে দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, প্রথমে ওই কৃষক বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, আমরা বিনা পারিশ্রমিকে তার ধান কেটে ঘরে তুলে দেব। পরে যখন তার জমির ধান কেটে বাড়িতে এনে দিলাম তার মুখের হাসি আমাদের অন্যরকম আনন্দ দিয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছুই নেই। এই দুঃ’সময়ে প্রত্যেকের উচিত কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো। যদিও ছাত্রলীগ ছাড়া এখনো কেউ সেভাবে এগিয়ে আসেনি।
কৃষক হাফেজ আহমেদ বলেন, একজন শ্রমিকের মজুরি ৫/৬’শ টাকা। তার উপর ২ বেলা ভাত দিতে হয়। এই ছেলেগুলো আমার বড় উপকার করে দিয়ে গেছে। তাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না, তবে মন থেকে দোয়া করছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মসজিদের ইমামের ক্ষেতের ধান কাটার টাকায় ত্রাণ বিতরণ ছাত্রলীগের:
মাওলানা আকরাম হোসাইন ধান কাটার শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দ্বারস্থ হন ছাত্রলীগের। এগিয়ে আসেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ধান কাটার বিনিময়ে টাকা দিতে চান মাওলানা আকরাম। ধান কাটায় অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা জানালেন, ওই টাকা নিয়ে তারা ত্রাণ কিনে করোনার কারণে এলাকার কর্মহীনের মাঝে বিলি করবেন। ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার।
গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই ব্যক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ধান কেটে দিয়েছেন। পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোগেই ওই ব্যক্তির বাড়িতে ধান পৌঁছে দেয়ার কাজটিও করেন।
ধান কাটার কাজে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কাজ করে তারা মাঠ কাটতে সক্ষম হন। বিনিময়ে জমির মালিকের কাছে নির্ধারিত কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় যে টাকা দিবেন তা দিয়ে কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়াবো।
কসবা উপজেলার জমসেরপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা আকরাম বলেন, জমিতে ধান পেকে যায়। কিন্তু কোনোভাবেই শ্রমিক ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা গঠিন সংগঠন মনিয়ন্দ ঐক্য পরিষদের দ্বারস্থ হই। ওরা ধান কাটার কাজ করে। আমার এই ধান কাটতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। ধান যারা কেটেছে তাদেরকে আমি ওই টাকা দিতে চাইলে নেয়নি। তবে তাঁরা বলেছে সময়মতো টাকা নিয়ে কর্মহীনের পাশে দাঁড়াবেন।
ধান কাটার কাজে নেতৃত্ব দেওয়া মনিয়ন্দ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রানা আহমেদ বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ এলাকার যুবকদের নিয়ে ধান কাটার কাজ করি। আমি ছাড়াও তানভীর, সাব্বির, সালমান, শওকত, জুয়েল, আলমাস, বাদল, বাবুল, সজীব এতে অংশ নেয়। ধান কাটার সময় হেলেনা নামে এক নারী এসেও তার জমিতে কাজ করে দেওয়ার অনুরোধ করলে আমরা রাজি হই। আমরা চিন্তা করেছি জমির মালিক তার ইচ্ছে অনুযায়ী যে টাকা দিবে সেই টাকায় কর্মহীনদের জন্য কিছু একটা করবো। মনিয়ন্দ ঐক্য পরিষদ আমাদের এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে। ধান কাটার সময় ওই সংগঠনের অনেকেসহ স্থানীয় গণ্যমান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু ও সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন নয়ন বলেন, ধান কেটে দেয়ার উদ্যোগটি ছিল খুবই প্রশংসনীয়। ধান কাটার টাকায় ত্রাণ দিলে সেটা আরো ভালো হয়। এর বাইরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নানাভাবে কর্মহীনদের সহয়াতা করা হচ্ছে। আশা করি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা করোনা পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরণের সহায়তায় প্রস্তুত থাকবে।