মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
বাংলা একটা কবিতার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।।’ হুজুগে মানুষের গুজব আর হা-হুতাশ শুনতে শুনতে বারবার শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি মনে আসছে। বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় কবি খুব ভালো করে নিজ দেশের মানুষকে চিনেছিলেন বলেই হয়ত এমন কবিতা লিখতে পেরেছিলেন।
সারা দেশে রব উঠেছে, ত্রাণের চাল সব হরিলুট হচ্ছে। নিচ্ছে ভাগ করে সব জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু আসলেই কি ত্রাণের চাল চুরি হচ্ছে? সত্য হলো, ত্রাণের চাল এখনো সরকারি গুদামে। তালিকা শেষ করে তারপর ছাড়া হবে। তাহলে এই চাল কিসের, আর চুরিই বা করছে কীভাবে? একটু খুঁজলে তার উত্তরও মিলবে। আসুন, একটু খুঁজে দেখি। তার আগে একটু দেখি দেশে কত ভাগ জনপ্রতিনিধি ‘চোর’।
বর্তমান সময়ে সবচাইতে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রল হচ্ছে, করোনা ভাইরাসে মা’রা গেছে যত, তার থেকে বেশি পাওয়া যাচ্ছে চোর। বিষয়টিকে আরো বাড়িয়ে বলে যাচ্ছি আমরা, ‘সকল জনপ্রতিনিধি চোর’। বাংলাদেশে করোনার চিত্র হলো, ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ৫০ জন। আক্রা’ন্তের সংখ্যা ১,২৩১। সুস্থ হয়েছেন ৪৯ জন। আর এদিকে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে চোর ধরা পড়েছে ১৪ জন। তারও অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও মেম্বার।
এবার দেখি বাংলাদেশে মোট জনপ্রতিনিধি কতজন। জনপ্রতিনিধির সংখ্যাটা হচ্ছে মেম্বার ৪১,১৩৯ জন, মহিলা মেম্বার ১৩,৭১৩ জন, ইউপি চেয়ারম্যান ৪,৫৭১ জন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ/মহিলা- ৯৮৪ জন, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯২ জন, পৌর মেয়র ৩৩০ জন, সংসদ সদস্য ৩৫০ জন। অর্থাৎ বাংলাদেশে মোট জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৬১,৫৭৯ জন।
এবার শতকরা হিসেবে আসি। মোট জনসংখ্যার তুলনায় জনপ্রতিনিধি ০.০৩ শতাংশ। এ থেকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা আর চোর, ডাকাত ও দুর্নীতিবাজদের অনুপাত বের করলে ঢের বেশি পাওয়া যাবে। অবশ্য এই ০.০৩ শতাংশ বলে যে তারা মাফ পেয়ে যাবেন, বিষয়টা এমন নয়। বরং এই ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন চেয়ারম্যান এবং ৫ জন মেম্বারকে বরখা’স্ত ও দল থেকে বহি’স্কার করা হয়েছে। কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়েছে আরো ২ জনকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে এদের প্রত্যেককে সাজার আওতায় নিয়ে আসা হবে। আর অনেকেই হয়ত ভুলে যাচ্ছেন, এই চোরদের ধরা হচ্ছে এবং তাদের মুখোশ উন্মোচন করছে বর্তমান সরকারের অধীনে থাকা প্রশাসন।
এবার আসি চালের খোঁজে। এগুলো করোনার লকডাউন উপলক্ষে দেয়া সরকারি ত্রাণের চাল নয়। এখন পর্যন্ত দেশে যতস্থানে চুরির চাল পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ বয়স্কদের, বিধবাদের বা ১০ টাকা দরে বিশেষ মূল্যে বিক্রি করা চালের। আর তা চুরি হয়েছে কীভাবে? ঐ যে বললাম, আমরা প্রত্যেকে অতি সৎ! আর সে কারণেই নিজের নাম একবার লিস্টে উঠানোর জন্য যেমন সচেষ্ট থাকি, একইভাবে হাতে যখনই সেই চাল এসে পৌঁছায়, বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লাগি। এই চালগুলো যাদের নামে ছিলো তাদের প্রত্যেককে সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে চাল তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সেটি নিয়ে আবারো বিক্রি করে দিচ্ছে অল্প কিছুদূরে গিয়ে। ধরা পড়া অধিকাংশ চালের পেছনের হিসেব এটি।
আসলে ক্ষমতাসীন দলের কতগুলো মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁ’কি নিয়ে বাইরে বের হচ্ছে মানুষকে সহায়তার জন্য, সমালোচনার সময় সেই হিসেব কি আমরা রাখি? আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশটা গরিব, একটা ছোট এলাকায় ৫০০ মানুষের ত্রাণ দরকার। এক্ষেত্রে হয়তো ত্রাণ সরবরাহ করা গেছে ২০০ জনকে। এ কারণে কিছু সমালোচনাও হচ্ছে। খালি পেটে করা সেই সমালোচনা ও গালি মুখ পেতে নিলাম। কিন্তু যারা নিজের ঘরে আরাম করে বসে বসে জমিয়ে রাখা খাবার খাচ্ছেন আর বলছেন, ‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ তার সেই কথা বলা আগে নিজের অবস্থানের কথা জানা উচিত। গাল ভরা সমালোচনা করতে করতে আমরা সবাই যদি নন্দলাল বনে যাই, তবে এই দেশের অবস্থা কী হবে?
১৯৭৪/৭৫ সালেও এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে না’জেহাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। রাতারাতি বাসন্তিকে জাল পরিয়ে লজ্জা নিবারণের ফটোসেশনের মাধ্যমে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়। ভুখা মিছিলও করানো হয়েছে। তাদের প্রেতাত্মারা আবারও ঘোলাজলে মাছ শি’কারে তৎপর। আওয়ামী লীগের যে নেতাকর্মীরা ঐসব বর্ণচোরাদের সমর্থন দিচ্ছেন তারাও সতর্ক হোন। এই শ্রেণী ঢালাওভাবে বলছে, ‘ওদের বাপ দাদারা কম্বল চুরি করেছে তাদের সন্তানরা ত্রাণ চুরি করছে।’ যারা কথাগুলো বলছেন এবং যারা তার পাশে কমেন্টে ‘সহমত’ লিখছেন, তারা কতটুকু সহায়তা করছেন নিজ প্রতিবেশী বা আত্মীয়কে। আপনার বাসার কাজের বুয়া এখন কী করছেন, কীভাবে জীবনযাপন করছেন সেই খোঁজ কী আপনার আছে? একবারও কি ভেবে দেখেছেন, আপনার এমন উক্তি ভালো কাজ করে যাওয়া মানুষগুলোকে ডিমোরালাইজ করছে?
কোন চোরের পক্ষে কথা বলার জন্য আসিনি, সত্যি কথাগুলো বললাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অ’ন্যায়কে সহ্য করে না। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এর থেকেও বড় ও শক্তিশালী নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিকে সাজার আওতায় আনা হয়েছে। ইনশাল্লাহ আমরা এই মহামা’রী কাটিয়ে উঠবো, আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
সর্বশেষে বলবো, চোরদের ধরিয়ে দিন। নিজের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। সমালোচনাটা হোক গঠনমূলক। মানুষের বিপদে দাঁড়াতে কোনো দল লাগে না। লাগে শুধু একটি মহৎ হৃদয়। যা প্রমাণের উপযুক্ত সময় এটি।
লেখক: খাজা খায়ের সুজন
পরিচিতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা।