পিনাকী ভট্টাচার্য: ওষুধের নামে ময়দা বেচে কোটি টাকা লোপাটের কারিগর

10

।। ডাঃ জাহিদুর রহমান ।।

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প জগতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক জালিয়াতের নাম পিনাকী ভট্টাচার্য এবং পপুলার ফার্মাসিটিক্যালস। ২০০৮ সালে পিনাকী ভট্টাচার্য পপুলারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কিছু দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে সিন্ডিকেট করে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে বিষয়টি নিয়ে তখন তেমন কোন আলোচনা হয়নি।

লজ্জার ব্যাপার যেই পিনাকী ভট্টাচার্য কালাজ্বরের ক্যাপসুলে ময়দার দলা পুরে কোটিপতি হয়েছে, তার কাছ থেকেই আজকে আমাদের সবার নৈতিকতার সবক নিতে হয়।

২০০৮ সালের মে মাসে কালাজ্বর নির্মূলের লক্ষ্য নিয়ে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে কালাজ্বরে আক্রান্ত রুগিদের মধ্যে বিনামূল্যে পপুলারের তৈরি ক্যাপস্যুল মিল্টেফস (মিল্টেফসিন) বিতরণ শুরু করে। ঋণ হিসেবে টাকাটা দেয়ার কথা ছিল ডব্লিউএইচওর, কিন্তু শর্ত ছিল যেসব ওষুধ কেনা হবে, সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ঐ ওষুধ উৎপাদনের কমপক্ষে ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা লাগবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টেন্ডার দিলে তাতে আবেদন করে দুটো কোম্পানি, একটি জার্মানির ইটার্না জেন্টারিস অপরটি বাংলাদেশের পপুলার। প্রথমটির তৈরি মিল্টেফসিন ছিল মানসম্মত, পরীক্ষিত, উৎপাদনের অভিজ্ঞতাও ছিল ২ বছরের বেশি। তারপরও কোন এক রহস্যময় কারনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পপুলারের তৈরি মিল্টেফসিন কেনে, যাদের এই ওষুধ তৈরির কোন পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। পরবর্তিতে পরীক্ষা করে এও দেখা যায় যে, পপুলারের মিল্টেফসের মধ্যে মিল্টেফসিনেরই কোন অস্থিত্ব নাই। এরকম মোটা দাগের দূর্নীতি দেখে ডব্লিউএইচও তাদের ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয়। শুধুমাত্র পপুলারকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আবারও টেন্ডার ডাকে এবং ২ বছরের অভিজ্ঞতার শর্তটি তুলে নেয়।

সরকার ৫ কোটি টাকার কালাজ্বরের ক্যাপসুলের নামে ময়দার দলা কিনে পপুলারের কাছ থেকে এবং পপুলারের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি দেখভাল করে প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার এবং আজকের সুশীল ছাগু সমাজের প্রতিনিধি পিনাকী ভট্টাচার্য। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কয়েকশো রুগিকে পপুলারের তৈরি মিল্টেফসিন ফুল ডোজে খাওয়ানোর পরও তাদের জ্বর কমেনি, পরীক্ষা করে তাদের সবার দেহেই আবার কালাজ্বরের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। অথচ জার্মানির তৈরি একই ওষুধ খেয়ে আগের সব রুগি সুস্থ হয়ে উঠেছিল।

জেনেশুনে জীবন রক্ষাকারী কোন ড্রাগ নিয়ে মানুষের সাথে এরকম প্রতারণা করা পিনাকীর মত অমানুষের পক্ষেই সম্ভব। মান কিছু কম হতে পারে, তাই বলে ক্যাপসুলের মধ্যে কোন ড্রাগই থাকবে না? পিনাকী ভট্টাচার্য অবশ্য তখনও তার স্বভাবসুলভ ভন্ডামি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে পপুলারের ওষুধ মানসম্মত। অথচ ডব্লিউএইচও নেদারল্যান্ড থেকে পরীক্ষা করিয়ে প্রমাণ করে পপুলারের তৈরি কালাজ্বরের মিল্টেফস ক্যাপসুল সম্পূর্ণভাবে মিল্টেফসিনবিহীন!

অবস্থা বেগতিক দেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পপুলারের মিল্টফস ক্যাপসুল সরবারহ বন্ধ করে এবং এই ওষুধের সব ধরনের উৎপাদন এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।

আমদের স্মরণশক্তি খুবই দুর্বল, তাই আমরা এই জঘণ্যতম অন্যায়ের বিস্তারিত জানতে চাই। জানতে চাই, পরবর্তিতে পিনাকী ভট্টাচার্যসহ পপুলার ফার্মা এবং এর সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের কী শাস্তি হয়েছিল? আমরা জানতে চাই, পপুলার থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার প্রায় ৪৫ হাজার মিল্টেফস ক্যাপসুলের কি পরিণতি হয়েছিল? কালাজ্বরের রুগিদের যে ওষুধের নামে ময়দার দলা খাওয়ানো হয়েছিল, তার দায়িত্ব কে নিয়েছিলেন? এ বিষয়ে কি বর্তমান সরকারের কিছুই করার নেই? দুদকের ক্ষমতা নেই মাত্র ৯ বছর আগের দুর্নীতির তদন্ত করার? নাকি তখনই মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে পিনাকী গং এত বড় দূর্নীতি করেও আইনের হাত থেকে ফসকে গিয়েছিল?

আর কারো কাছে না হোক, ডব্লিউএইচও ও টেলিগ্রাফ পত্রিকার কাছে অবশ্যই পিনাকী ভট্টাচার্য এবং পপুলারের যাবতীয় অপকর্মের দলিলপত্র আছে। সেগুলো কি আবার সামনে নিয়ে আসার কোন উপায় নেই?

মিল্টেফস নিয়ে “The American Journal of Tropical Medicine and Hygiene” এর জার্নালের লিংক

পড়ুন: পিনাকী ভট্টাচার্যের মিথ্যাচারের জবাবে ডাঃ জাহিদুর রহমান যা বললেন

পরিচিতি: ভাইরোলজিস্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।